অসম প্রেম, অসম ভালবাসার , প্রেমের উক্তি- Unrequited love

অসম প্রেম |Unrequited Love: আনন্দদায়ক বেদনা ও অসম প্রেমের উক্তি

Last updated on June 18th, 2024 at 01:02 pm

অসম প্রেম বা Unrequited love হলো বিনিময়ে ভালবাসা পাওয়ার পরিবর্তে কাউকে একতরফাভাবে ভালবেসে যাওয়ার অনুভূতি। যেখানে ভালবাসার বিনিময়ে ভালবাসা না পাওয়া গেলে আপনার অনুভূতিগুলি হয়তো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।স্প্যানিশ কবি ফ্রেড্রিকো গার্সিয়া লরকা বলেছিলেন, “কামনার আগুনে জ্বলে ও তা বলতে না পারার সবচেয়ে বড় শাস্তিই আমরা আমাদের উপর নিয়ে আসি”। আমেরিকান লেখক জন গ্রিন বলেন “যে আপনাকে বিনিময়ে ভালবাসতে পারে না এমন কাউকে ভালবাসেন কারণ কোন না কোন উপায়ে অসম প্রেম সম প্রেমের চেয়ে বেশি দিন বেঁচে থাকে”।

অসম প্রেম বা ভালবাসা বা একতরফা প্রেম বা ভালবাসা হল এমন প্রেম বা ভালবাসা যা প্রেমিক বা প্রেমিকা কর্তৃক সরাসরিভাবে আদান-প্রদান বা গ্রহণ করা হয় না। এতে একজন ভালবাসার মানুষ একজন গুণমুগ্ধ, অনুরাগী বা রূপমুগ্ধ ব্যক্তির গভীর ও নিরেট অনুরাগ সম্পর্কে অবগত থাকে না, বা সচেতনভাবে সেই প্রেমকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে। আমেরিকান দার্শনিক রবার্ট বি. পিপিন দাবি করেন যে, ”অসম প্রেমই কেবলমাত্র সফল বা দীর্ঘস্থায়ী প্রেম।”

মনঃচিকিৎসক এরিক বার্ন তার Sex in Human Loving বইয়ে বলেছেন যে “অনেকে বলে যে একতরফা ভালবাসা শুন্যতার চেয়ে ভালো, কিন্তু অর্ধেক রুটির মতো, এটি শীঘ্রই শক্ত এবং ছাঁচে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।” তবে, দার্শনিক ফ্রেডরিখ নিটশে দাবি করে যে “প্রেমিক বা প্রেমিকার কাছে অপরিহার্য বিষয়টি হল অসম প্রেম , যা সে কোন মূল্যে উদাসীনতার অবস্থার দরুন পরিত্যাগ করবে না। অসম প্রেম বা ভালবাসা redamancy বা বিনিময়ে ভালবাসার পাওয়া থেকে আলাদা কিছু।

অসম ভালবাসাকে দীর্ঘকাল ধরে মহৎ, নিঃস্বার্থ এবং যন্ত্রণাকে গ্রহণ করার জন্য দৃঢ় ইচ্ছা ইচ্ছা পোষণ হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। ” উপন্যাসিক ক্যারল রিফকা ব্রান্ট বলেন, “সম্ভবত যাদের আমি পাব না তাদের সাথে প্রেমে পড়াই আমার নিয়তিতে ছিল। সম্ভবত একদল অসম্ভব প্রকারের মানুষ তাদের খুঁজে পাওয়ার জন্য আমার অপেক্ষা করছে। অপেক্ষা করছে আমাকে বারংবার সেই একই অসম্ভবকে অনুভূত করার জন্য”।

অসম প্রেম | Unrequited love

১৭ শতাব্দীর ইংলিশ কবি জন ড্রাইডেন ভালবাসার আনন্দের কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন, “ভালবাসার যন্ত্রণা অন্যান্য সব আনন্দের চেয়ে বেশি মিষ্টি”। “কারো কাছ থেকে ভালবাসা পাওয়ার চেয়ে যাদুকরী বিস্ময় আর কোনটাই নেই: আর তা হল তার কাঁধে ঈশ্বরের হাত রাখার মতো”, বলেন ব্রিটিশ নাট্যকার ও উপন্যাসিক চার্লস মর্গান। জার্মান মনো-বিশ্লেষক ও দার্শনিক এরিক ফ্রম বলেন, “মানব অস্তিত্বের সকল সমস্যার সু-যুক্তিপূর্ণ ও সন্তুষ্টিজনক উত্তর হল ভালবাসা।”

আমেরিকার সমাজ সংস্কারক ও ধর্মযাজক হেনরি ওয়ার্ড বীচার ভালবাসা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, “ভালবাসা হল পৃথিবীতে জীবনের স্রোতস্বিনী।” ব্রিটিশ দার্শনিক বাট্রান্ড রাসেল বলেছিলেন, “ভালবাসাকে ভয় করা মানে জীবনকে ভয় করা, আর যারা জীবনকে ভয় করে তাদের তৃতীয় অংশ ইতিমধ্যে মারা গেছে।” “জীবনের প্রধানতম শান্তি হল কেউ যে আমাদের ভালবাসে তার দৃঢ় বিশ্বাস থাকা।”

Valentines day 2010
Valentine’s day 2010 film

‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ চলচ্চিত্রের প্রধান পুরুষ চরিত্র বলেন যে, “ ভালবাসাই কেবলমাত্র বেদনাদায়ক কর্ম যা গ্রহে ঠিকে আছে ” । পারস্যের কবি রুমি’র মতে “ আমরা যা প্রত্যাশা করি তা হলো ভালবাসার গোলমেলে উৎফুল্লতা”। মানব জীবনে মানুষের প্রকৃত আনন্দ কিসে নিহিত তা নিশ্চিত করে বলা ভালবাসার অনুভূতির মতোই কঠিন।

যদিও ভালবাসা বা প্রেম মানুষকে, মানুষের স্বীয় সত্তা ও বুদ্ধিকে কিভাবে অসাড় করে দিতে পারে তার দিক বর্ণনা করতে গিয়ে ফরাসি লেখক জুল্স রেনার্ড বলেছিলেন, “ভালবাসা হল বালিঘড়ির মতো, হৃদয় পূর্ণ হওয়ার সাথে সাথে মানুষের মস্তিষ্কও খালি হতে থাকে।” ইংলিশ দার্শনিক ফ্রান্সিস বেইকন তাতে বলেন, “ভালবাসা আর জ্ঞানী হওয়া একসাথে সম্ভব না।” ফরাসি নীতিবিদ ফঁসোআ ড্য রশফোঁকো লিখেছিলেন, “ভালবাসা হল এক মনস্তাত্ত্বিক অভিজ্ঞতা। সবাই ভূতের গল্প বলে, তবে খুব কমই তা দেখেছে।

ভালবাসা আর জ্ঞানী হওয়া একসাথে সম্ভব না।Francis Bacon.

তবে ভালবাসার এই গোলমেলে অনুভূতিটুকুই মানব জীবনের জীবনায়ু। এতে পাওয়ার আনন্দ আর না পাওয়ার বেদনা যেমন অবশ্যম্ভাবী তেমনি পেয়ে হারাবার ভয়ও মানস্পটে আঁটানো। আবার লব্ধ ভালবাসার অনেক ফুল অকালে ঝরে যেতে আর অসময়ে ম্রিয়মাণ হয়ে যেতেও অনেক দেখেছি। ভালবাসার আর ভালবাসার মানুষটির অভাবে যেমন অসংখ্য জনের বেদনা রয়ে যায় তেমনি এর লভ্যতার গ্লানি অনেক কে যাতনাও দেই।

ভালবাসাই কেবলমাত্র বেদনাদায়ক কর্ম যা গ্রহে এখনও ঠিকে আছে।Valentine’s Day 2010

কোথায়, কখন, কার সাথে এই আনন্দময় বেদনার সূচনা হয় তার কোন তত্ত্ব উদ্গাটন হয়নি আদৌ। ভালবাসা, মোহ আর কামনা’র মাঝে একটা মনস্তাত্ত্বিক ফারাক বিদ্যমান থাকলেও জৈবিক-ভাবে এ কেবল প্রজননের দিকে ধাবিত করার এক রাসায়নিক কৌশল মাত্র। ডারউইন যেমনটা বলেন, প্রজনন ব্যতীত প্রাণীর আর কোন উদ্দেশ্য নেই’।  জৈবিক আর মনস্তাত্ত্বিক বিভেদের তত্ত্ব ব্যতিরেকে ভালবাসার যে ভাল লাগার অনুভূতি তা মানুষই একমাত্র প্রাণী যা বারংবার প্রত্যাশা করে।

প্রেমের সমতায় মানুষের আকর্ষণ কম থাকলেও অসম প্রেম আর তার প্রগাঢ় অনুভূতির পূজা করে মানুষ। এতে আনন্দ আর উত্তেজনা যেমন আকাশচুম্বী তেমনি হারানোর কষ্ট অনেক কে ভাবিয়ে তুলে। যুক্তরাজ্যের রাজা ৮ম এডওয়ার্ড  যুক্ত রাষ্ট্রের ৬ষ্ট বারের মতো বিবাহিতা এক মহিলার প্রেমে আটকা পড়লে তাঁর সিংহাসন বিসর্জন দিতেও তিনি দ্বিতীয়বার চিন্তা করেন নি।

অসম প্রেমের উপর গড়া বলিউডের চলচ্চিত্র ‘সাইরাট’ আমার বুক কাপিয়ে তুলেছে যতবার দেখেছি। মানুষ সব সময় অর্জন-মুখি। বিজয়-মুখী। বিজয় আর অর্জন মানুষের রক্তে আদিকাল থেকে। সম প্রেমে মানুষ অর্জনের আর বিজয়ের নিশানা খুঁজে পায় না, যেখানে মানুষের বৈষয়িক আর সামাজিক সামর্থ্যই মৌলিক উপাদান। অসম প্রেমে মানুষ তার বীরত্বকে কাজে লাগায়। অর্জনকে প্রাধান্য দেয়। এটি একটি দুঃসাহসের পদক্ষেপ, যা সবার হয়ে ওঠে না। তবে ভালবাসার এই বীরত্বপূর্ণ অর্জনে ভালবাসার অনুভূতি কতদিন উষ্ণ থাকে তা বলাই বাহুল্য।

সম হোক বা অসম প্রেম তো প্রেমই। হোমারের মহাকাব্য ইলিয়াডের উপর ভিত্তি করে নির্মিত হলিউডের চলচ্চিত্র ট্রয়ে ভালবাসা আর সৌন্দর্যের দেবী এফ্রোডাইটি রাজপুত্র প্যারিসকে বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দরী যে মহিলার প্রতিশ্রুতি করেছিলেন তা ছিল তার শত্রু পক্ষের একজন, মেনেলাউসের বিবাহিতা স্ত্রী।

আমরা যা প্রত্যাশা করি তা হলো ভালবাসার গোলমেলে উৎফুল্লতা।-পারস্যের কবি রুমি, প্রেমের উক্তি

অসম প্রেমের বাজার খুব চাঙ্গা চলছে আজকাল। এতে আবেগ, উত্তেজনা, আনন্দ প্রকট, বিজয় মহান। অর্থনৈতিক অসমতা, সামাজিক অসমতা, বয়সের অসমতা, ধর্মের অসমতা, শিক্ষাগত অসমতা, বর্ণের অসমতা, জাতিগত অসমতা ভালবাসায় বড় বিপত্তি। আমি বিশ্বাস করি মানুষকে মানুষ যখন, যেখানে, যাকে যেভাবে ইচ্ছে ভালবাসবে।

মানুষের এই প্রাকৃতিক বিষয়াদিতে রাষ্ট্র, সমাজ, ধর্ম আর স্বার্থকে কাজ করতে দিলে প্রাণীর স্বাভাবিক জৈবিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। যখন মানুষের প্রাকৃতিক আবেদন আর আকর্ষণে মানুষ আর তার মস্তিস্ক বাধাগ্রস্ত হয়, তখন সে সামাজিক নৈতিক বাধা সমূহকে অবজ্ঞা করতে চেষ্টা করবে। মানসিক বিকারগ্রস্ততা চেপে বসবে। একজন মানসিক বিকারগ্রস্ত মানুষ সামাজিক ভয়েরও কারণ হয়ে ওঠতে পারে। তবে, মানুষ যেন ভালবাসাকে আশ্রয় করে নিউরোরজিক্যাল আসক্তিতে আসক্ত না হয়ে পড়ে। কারণ, ভালবাসা আর যৌনতা একটি শক্তিশালী আসক্তি।

আমার সত্ত্বা ও অসম প্রেম/ একতরফা ভালবাসা / unrequited love

আমি অসম প্রেমের বেদনাকে যত্ন করি, কারণ তা আমাকে ভাবতে শেখায়। মানুষের অনুভূতিকে জানতে শেখায়। হতাশ হতে শেখায়। কারণ হতাশ না হলে কোন বস্তুকে নিয়ে গভীর চিন্তা করা যায় না, আর চিন্তা না করা গেলে কোন বস্তুকে গভীর করে জানা যায় না। আর আর আমি প্রেমকে গভীরভাবে জানতে শিখেছি বহুকাল ধরে। হেমন্ত মুখোপধ্যায়ের ‘নীড় ছোট ক্ষতি নেই আকাশ তো বড়’ এর আকাশ বড়ই রবে তবে নীড় আর গড়া হবে না। আমি প্রেমের সমতায় বিশ্বাসী নই, তাই অসমতায় বারবার ঘুরে-ফিরি।

আজ আরও একটি অসম অনুভূতি বা ভালবাসার আত্মহনন আর প্রেমানন্দের কথা বলা হোক, সুবর্ণাকে। বহুদিন ধরে সুবর্ণাকে মূর্তিমান করে তুলা হয়েছে আমার কল্পনায় যার সাদৃশ্য গ্রহে দ্বিতীয়টির অস্তিত্ব নেই। আর যার প্রতি অনুভূতিরও আমি সীমানা নির্মাণ করিনি। ভালবাসা আর ভাল লাগার অনুভূতি উত্তাল সমুদ্রের ঢেউয়ের ন্যায় কখনো কখনো আঁচড়ে পড়ে। কাল, ইতিহাস, ঐতিহ্য, লৈঙ্গিক আকর্ষণ আর সাহিত্যের খাতিরে একে আমরা ভালবাসা বলে সম্বোধন করতে ভালবাসি। আর একে ভালবাসি বলেই আমরা ‘ভালবাসা’ বলে থাকি। আর একটি অপূর্ব সৃষ্ট সুন্দরীকে আমি সুবর্ণা বলে থাকি।

সুবর্ণা আমার প্রাত্যহিক আচারে পরিণত হয়েছে আজকাল। আমার বিবেক, ধ্যান, জ্ঞানে সুবর্ণা এক অবিরাম মন্ত্রে রূপ নিয়েছে। সে আমার আসক্তি, অনুরাগ আর আবিষ্টতায় রূপ নিয়ে নগরের সব দালানের ছাদে আর সকল প্রযুক্তি-যন্ত্রে বিরাজ করে নিয়ত। এই আবিষ্টতা আমাকে দংশন করে, তাড়না জাগ্রত করে, আবেগকে অসাড় করে। তবুও তা আমায় প্রশান্তি দেয়।

ভালবাসতে পারার যে প্রাণী যোগ্যতা লাভ করে, তাকে ভালবাসার মাঝ আমি তার অস্তিত্ব পাই। আমি তাতে অনুধাবন করতে সচেষ্ট হয়েছি যে মানুষ ভালবাসা পাওয়ার জন্য নয়,বরং ভালবাসা উজাড় করে উপচে দেওয়ার জন্য তার সমকক্ষ কাউকে সন্ধান করে। যেন এই উদারতা মাঝেই তার প্রশান্তি, প্রাপ্তি।

অসম প্রেম হলো কোনো নিঃসঙ্গ হৃদয়ের অসমাপ্ত অভিশাপ। —খ্রিষ্টিনা ওয়েষ্ট, প্রেমে উক্তি

পেশাগত সহাবস্থানের দরুন সুবর্ণাকে তার স্বীয় আবহে নির্মাণের সন্ধান পাওয়া। এ কোন সুবর্ণ চরের সুবর্ণা নই। এ যেন কঙ্গোলিসদের একটুকরো ডায়মন্ডের সন্ধানে দিনের পর দিন পাথর খনন পর সন্ধান পাওয়া মহামূল্যবান পরশ পাথর। এ সৌন্দর্যের ব্যাখ্যা হই না, এ পাওয়ার অনুভূতির প্রকাশ অসমীচীন, এ আনন্দের অস্তিত্ব প্রাণী গ্রহে অদ্বিতীয়। ভাবুকরা কি এমনই হয়! সকল প্রেমের সকল ঘটনা সমূহ তাদের কাছে নতুন ঠেকে কেনো?

মানবী সুবর্ণার বর্ণনা সে নিজেই। তবে, যে মানব তাকে মূর্তিমান করেছে, তার প্রতি সকল অনুভূতির লালন করে সযত্নে, যে তাকে কেন্দ্র করে মহাজাগতিক বিলিয়ন সেকেন্ড আগ্নেয়গিরিতে পুড়িয়েছে, যে তাকে দেবীতে নির্মাণ করেছে তার নির্মাণ শৈলীর কৌশল সম্পর্কে তো জানা প্রয়োজন! সে সুবর্ণাকে নির্মাণ করেছে সুদীর্ঘ এক অবয়বে। তারপর তাতে সে মসৃণ, শীতল, অনুভূতি প্রবণ এক ত্বকের প্রলেপ বিছিয়ে দিয়েছে পুরো অঙ্গ জুড়ে। কুঁকড়ানো কালো কেশের পর এক অপ্রাপ্ত বালিকার ঠোঁট মুখে সংযোজনের পর গভীর দুটো নয়ন চিত্রিত করল। যে নয়ন তার হৃদয়ে বার্তা ছড়িয়ে যায় প্রতিনিয়ত, যে নয়ন প্রাণী জগতকে সমৃদ্ধ করার কামনায় সমৃদ্ধ।

শালীন আবরণ। মৃদুতা, মসৃণতা, শালীনতা, উদারতা, সম্ভ্রমতা আর স্নিগ্ধতায় সে তাকে সাজিয়ে, তাকে বাংলার স্নিগ্ধতা আর মায়াময়ী কণ্ঠের অধিকারী গীতা দত্তের সুরের অধিকারীও করেছে।  বিবাহিতা এই মানবীর হাতের আঙ্গুলদয়ের ফাঁক দিয়ে জ্যোৎস্না রাতের নারিকেল ডালের ফাঁক দিয়ে ছড়িয়ে পড়া জ্যোৎস্নার আলোর মতো নিয়তই আলো ছড়ায়। পা’দয় ভোরের ঝরে পড়া বকুল ফুলের ন্যায় মুগ্ধকর আর সুভাষিত।

উপমহাদেশের বিখ্যাত কণ্ঠ শিল্পী পঙ্কজ উদাস তাঁর বিখ্যাত গজল চাদিঁ যেই চা রং হ্যা তেঁরা তে পায়ের সৌন্দযের্র উপমাতে বলেন,জিস রাস্তেচে তু গুজরে, ও ফু লোচে ভর যায়ে, তেরে পায়ের কি কোমল আহাট চুতে ভাগ জাগায়ে–‘তুমি যে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাও তা ফুল  ফুটে ভরে যায়, তোমার পায়ের কোমল আওয়াজ নিদ্রিতদের জাগ্রত করে’। মোহনীয় এই পায়ের পাদ তলে দেবী প্রাসাদ উৎসর্গে সে মানবটির কোন আপত্তি নেই।

মুখোমুখি আকস্মিক অবস্থানে কতবার নিজেকে গুলিয়ে ফেলেছি, কতবার শব্দ চয়নে ব্যর্থ হয়েছি, কতবার বাক্য নির্মাণে সফলতা হারিয়েছি, কতবার আত্ম সম্মানবোধ কে বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছি, কতবার ধ্যান ভগ্ন হয়েছি, কতবার কত রঙ্গের মিশেল-সন্ধি আবিষ্কার করেছি তার ঠিকানা রাখা হয়নি।

অসম আর্তনাত

সৌন্দর্যের এই নির্ণয়, নির্মাণ সমাপ্ত হয়ে একে মুগ্ধ নয়নে কয়েকটি বার ভাব-বিনিময়ের সূচনা হ’তেই বিচ্ছেদের ডাক আসলো সুবর্ণার। এবার সুবর্ণা ভাঙ্গা-গড়ার এই ক্যানভাসের চরিত্র , ভালবাসার তুলির রং হওয়ার অংশ চুকিয়ে দেবে। কারণ ভালবাসার শুভ্র অনুভূতির চেয়ে, ভালবাসার যৌগ রসায়নের মিশ্র আবেগের চেয়ে পৃথিবীতে এই কোমল হৃদয়ে মানবীর জন্য আরেক অনুরাগের দিগন্ত অপেক্ষমান। তার কাছে কোন বিচ্ছেদ, বিচ্ছেদ নই, কোন ভাঙ্গন, ভাঙ্গন নই, কোন আবেগ ভালবাসা নই, কারণ এই হিসেব সে আগেই চুকিয়ে দিয়েছে কোন এক সফল পুরুষের সাথে।

অনুভূতির সাগরে ভেসে চলা মানব এই ভাঙ্গনের পরিণতির হিসেব কষতে বসেছে এ অসম প্রণয়ের। কোন এক জ্যোৎস্না রাতের আলোয় যখন নগরের সকল কোলাহল ম্রিয়মাণে ধাবিত, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের যুক্তি ছিন্ন করে এক পত্রের নমুনা গড়ে—

প্রিয় সুবর্ণা,

এই গ্রহে আজও দিন-রাত্রি আসে। ফুলে পরা-গায়ন ঘটে নিয়তই। যে সড়ক সমূহ নদীর জলে স্নাত হতো তার নিয়ম এখনও বিদ্যমান। শিক্ষার্থীদের গুঞ্জন আছে আগের মতোই। তোমার অনুপস্থিতিতে সব স্বাভাবিক মনে হলেও ছাত্ররা তোমার হাতের লিখায় তোমার অবয়ব খুঁজে বেড়ায় আজ অবধি।

তবে খাঁচার পাখিদের গুঞ্জনে স্থবিরতা এসেছে। তারাও কি তোমার গায়ের সুরভির অনুপস্থিতি আচঁ করছে তাহলে? বিদ্যালয়ে এক জোড়া জুতোর আকৃতি মাঠের বালুকণায় আর আকৃতি আকেঁ না, সব ভেসে গেছে, মুছে গেছে  তোমার সক পদ-চিহ্ন।  চায়ের কাপে তোমার রাঙ্গা ঠোঁটের লিপস্টিক রাতারাতি উদাও। অনেকের কাছে বিষয়টা খুব স্বাভাবিক। হয়তো বা প্রয়োজন তাই। অপ্রয়োজনে সকল শুন্যতাই চিহ্ন রেখে যায়।

তোমার শূন্যতা অনুভব করতে হলে হৃদয়ে উত্তালতা আর নিষ্ক্রিয়তার অস্তিত্ব অনুভব করি। সকল উত্তপ্ততা, আয়োজন, প্রয়োজন, হিসেব-নিকেশ আর স্বীয় অস্তিত্বের অবস্থান নিয়ে সন্দিহান বেড়ে যায়। বুকের ভেতরটা গ্রীষ্মের ভর-দুপুরের ন্যায় খাঁ খাঁ করে উঠে, বুক আটকে যেতে চায়। প্রতিক্ষা আর প্রত্যাশার সকল বিনিময়ের সমাপ্তি ঘটেছে। সমাপ্ত হয়েছে আবেগ আর অনুভূতির বুনন।

তোমার গন্ধ বাতাসে ভেসে আসে না বলে গ্রহের সকল দামী পারফিউম আর কোন গন্ধ চড়ায় না। তোমার কণ্ঠ বাজে না বলে সকল গান আজ ছন্দ-হীন, সুরহীন আর্তনাদ কেবল। কতবার বাতাসে তোমার গন্ধ খুঁজেছি, কতবার তোমার পায়ের নিঃশব্দ পদক্ষেপগুনতে চেয়েও ব্যর্থ হয়েছি। কতবার উদাসীন হয়ে শহরের মানুষের সংখ্যা গুনেছি তা জান কি?

এমন শূন্যতার অনুভব কখনো উপলব্ধি করেনি আগে। কদিন পর শিক্ষার, শিক্ষণের, শিক্ষকের আর শিক্ষার্থীদের সকল আয়োজন থেমে যাবে অনিশ্চিত কালের জন্য। তোমার সকল আকর্ষণ আর সৌন্দর্য হয়তো একদিন সময়ের গহরে বিলিন হবে, তবে তোমার প্রতি আমার মোহ অটুট রবে অনন্তকালের জন্য।

-দেবী সেবক

অনেক সমাজে ভালবাসা ভীষণ এক অপরাধ। পাকিস্তানে পিতা-মাতার অমতে প্রেমে জড়ালে হত্যা করাও বৈধ। প্রেম-ভালবাসা আর যৌনতার সৌন্দর্যকে বরণ করে নেওয়ার জন্য কতজন ভালবাসার মানুষকে যে বাংলাদেশ, ব্রাজিল, মিশর, জর্ডান, পাকিস্তান, মরক্কো, তুরস্ক, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশে মৃত্যুকেও বরণ করে নিতে হয়েছে তার হিসবে কি সমাজ রেখেছে?

বিয়েতেই কি মানুষের প্রতি মানুষের প্রেমের বা ভালবাসার দায়বদ্ধতার সমাপ্তি হয়ে যায়? বিবাহ হতে পারে বৈধভাবে সম্ভোগের বা সন্তান জন্মদানের এক তথাকথিত সমাজ স্বীকৃত উপায়, তবে ভালবাসা যে কেবল এক বিবাহের শৃঙ্খলে বন্ধী থাকবে তার কোনও নিশ্চয়তা নাই। মানুষের অনুভূতি, আবেগ আর প্রেমকে শৃঙ্খলে রাখতে চাইলে সমাজের স্বীকৃত সব অনিয়মই একসময় নিয়মে পরিণত হতে পারে।

মাঝে মাঝে মনে হয় মানুষের কোনও জাত-গোত্র থাকার প্রয়োজন নেই। পৃথিবীর সব মানুষেরই থাকবে একটি সমাজ, একটি গোত্র যেখানে মানুষ যে যখন যাকে খুশি ভালবাসবে, শুবে, পিতা হবে, মাতা হবে, আর সবাই হবে সবার মাতা-পিতা, যেমনটা হয় ম্রুনাস জনগোষ্ঠীতে।

101 best films you must watch


 

বয়স আর আসক্তি আমাকে বারংবার অসম প্রেমের দিকে ধাবিত করেছে। ধাবিত করেছে কারও অর্ধাঙ্গিনী বা মাতৃ সৌন্দর্যের প্রতি, বা তার চেয়েও মহান অসম কারও প্রতি। লেখিকা খ্রিষ্টিনা ওয়েস্টোভার বলেন যে, “অসম প্রেম হলো কোনো নিঃসঙ্গ হৃদয়ের অসমাপ্ত অভিশাপ”। অথবা ধরা যাক রোজ গর্ডনের, “যার প্রেম অন্য কোথাও নিহিত রয়েছে এমন কারও প্রেমে পড়ার বেদনা না পাওয়া পর্যন্ত কেউ প্রকৃত বেদনা বুঝতে পারে না”। কেবল নিঃসঙ্গতা আর প্রেমহীনতা নয়, বরং দুর হোক অসম প্রেমের প্রতি সকল বিপত্তি।

আবার, মানব জীবনে ভালবাসা বা প্রেম যে কতটা ব্যয়বহুল বিলাসিতা বা আরাম-আয়েশের উপায় হতে পারে তাও ভালবাসার মানুষগুলি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়নি। ভিক্টোরিয়ান যুগের উপন্যাসিক এন্থনি ট্রলপ উল্লেখ করেন, “ভালবাসাও অন্যান্য হল বিলাসিতার মতো। আপনার সামর্থ্য না থাকলে তাতে আপনার কোনও অধিকার নেই।” আসলেই ভালবাসা বা প্রেম আজকাল এক ব্যয় বহুল দিক হয়ে উঠেছে। সামর্থ্যবান মানুষগুলির প্রেমের ঘাটতি না থাকলেও, দিন শেষে রয়ে যাচ্ছে নিঃসঙ্গতাও।

ভালবাসাও অন্যান্য বিলাসিতার মতো। আপনার সামর্থ্য না থাকলে তাতে আপনার কোনও অধিকার নেই।Anthony Trollope

প্রয়োজন অনেক কিছুই গড়ে। আর প্রয়োজনই হয় ভাঙ্গনের কারণ। ভালবাসা তার মধ্যে একটি। বিচ্ছেদ মানুষের সুযোগ হরণ করে, বাসনা নয়; অবস্থানের দূরত্ব সৃষ্টি করে, অনুভূতির নয়; মিলনে ব্যাঘাতের জন্ম দেয়, স্বপ্ন নয়। ভালবাসার ধরণ যাই হোক, অনুভূতির আকার যেই হোক, যত ভাল লাগার সুবর্ণা আসে আসুক, তবে এ সুবর্ণা হৃদয়ে যে চিত্র এঁকে দিয়ে গেছে তা সে আমৃত্যু বহন করতে প্রস্তুত। ভাল থাকুক পৃথিবীর সকল ভালবাসারা সেই সাথে সকল ভালবাসার মানুষেরা।

ফেব্রুয়ারী, ২০১৯

Comments are closed.

Scroll to Top