man's search for meaning Bangla translation

Man’s Search for Meaning Bangla-ম্যান্স সার্চ ফর মিনিং জীবন বদলে দেওয়া Inspiring বইয়ের বাংলা অনুবাদ 2023

Last updated on January 24th, 2024 at 02:19 pm

একজন মানুষ যখন বুঝতে পারে যে যন্ত্রণাভোগই তার নিয়তি, তখন তার একক আর অনুপম কাজ হিসেবে তাকে তা গ্রহণ করতে হবে। তাকে স্বীকার করে নিতে হবে যে এমনকি যন্ত্রণাভোগের মাঝেও ব্রহ্মাণ্ডে সে অনুপম বা স্বতন্ত্র এবং একক। কেউই তাকে যন্ত্রনাভোগ থেকে উদ্ধার করতে পারে না বা তার স্থলে অন্য কেউ তার নিজের যন্ত্রণাভোগ করতে পারে না। যেভাবে একজন মানুষ তার কষ্টকে বহন করে তাতেই তার স্বতন্ত্র বা অনুপম সুযোগ অন্তর্ভুক্ত।

কয়েদী হিসেবে আমাদের বেলায় এসব ভাবনা সমূহ বাস্তবতার অনুমান থেকে দুরে ছিলনা। কেবল সেসব ভাবনাই আমাদের কাজে লাগতো। সেসব ভাবনা আমাদের হতাশা থেকে দূরে রেখেছিল, এমনকি যখন শিবির থেকে জীবিত বের হওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না বলে মনে হতো তখনও। জীবনের অর্থ কি তা প্রশ্ন করার স্তর আমরা অনেক আগেই পার করে এসেছি। এটি একটি সরল প্রশ্ন যা জীবনকে মূল্যবান কিছুর সক্রিয় সৃষ্টির মাধ্যমে কোনো লক্ষ্য অর্জন হিসেবে বোঝানো হয়। আমাদের বেলায়, জীবনের অর্থ জীবন-মৃত্যুর, যন্ত্রণাভোগের এবং মরণের বিস্তৃত চক্রের সাথে জড়ানো ছিল।

যখনই যন্ত্রণাভোগের অর্থ আমাদের কাছে প্রকাশিত হলো, আমরা শিবিরের  অবজ্ঞা বা মিথ্যা মোহের আশ্রয়ে এবং কৃত্রিম আশাবাদ পোষণ করে নির্যাতনকে হ্রাস বা প্রশমিত করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলাম। যন্ত্রণা বা যন্ত্রণাভোগ আমাদের তরে হয়ে ওঠে এক কর্ম যা থেকে  আমরা পিছপা হয়নি। সাফল্যের জন্য আমরা যান্ত্রণাভোগের গোপন সুবিধা সমূহ অনুধাবন করতে পেরেছিলাম। যে সুবিধা সম্পর্কে অস্ট্রিয়ার কবি মারিয়া রীলকে লিখেছিলেন, Wie viel ist aufzuleiden! সফল হওয়ার জন্য কতটা যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়! (How much suffering there is to get through!) রীলকে “যন্ত্রণা সহ্য করা বা যন্ত্রণায় সফল হওয়া” সম্পর্কে বলেছিলেন, যেমনটি অন্যরা যন্ত্রণার চেয়ে “কাজকে সহ্য করা” র কথা বলতো। আমাদের মাঝে সহ্য করার জন্য প্রচুর যন্ত্রণা ছিল। অতএব, দুর্বলতা আর লুকিয়ে কান্না করার মুহূর্তগুলিকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখার প্রচেষ্টার মাধ্যমে সম্পূর্ণ অর্থে যন্ত্রণার মুখোমুখি হওয়া প্রয়োজন ছিল। তবে চোখের জল নিয়ে লজ্জা পাওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিলনা, কারণ চোখের জল মানে একজন মানুষের সর্বাধিক সাহস থাকা, যন্ত্রণাভোগের সাহস। কেবল কয়েকজন মানুষই তা অনুধাবন করতে পেরেছিল। কিভাবে তার ইডেমা রোগ থেকে মুক্তি পেয়েছিল সে প্রশ্নে একজন কর্মী তার স্বীকারোক্তি দিয়ে আমাকে বলেছিল, “আমি কেঁদে কেঁদে তা আমার অন্ত্র থেকে বের করে দিয়েছিলাম”। তার মতো কখনো সখনো লজ্জিত মুখে কেউ কেউ তাদের গোপন কান্নার কথা স্বীকার করতো আমার কাছে।

*********

সম্ভব হলে সাইকোথেরাপিউটিক বা মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা বা সাইকোহাইজিনিক বা মানসিক স্বাস্থ্যবিধির সূক্ষ্ম আরম্ভ ছিল স্বভাবতই হয় ব্যক্তিগত না হয় সমষ্টিগত। অনেক সময় ব্যক্তিগত সাইকোথেরাপিউটিক বা মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা প্রচেষ্টা ছিল এক রকম “জীবনরক্ষা প্রক্রিয়া”। এসব প্রচেষ্টা সাধারণত কয়েদিদের আত্মহত্যাকে প্রতিরোধের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। শিবিরের কঠোর নিষেধাজ্ঞা অনুযায়ী আত্মহত্যা করতে চেষ্টা করা এমন কাউকে বাঁচানোর প্রচেষ্টা ছিল নিষিদ্ধ। উদাহরণ সরূপ বলা যেতে পারে, নিজেকে ঝুলানোর চেষ্টা করছে এমন কাউকে গাছ কেটে নামিয়ে আনা নিষিদ্ধ ছিল। তাই এধরনের আত্মহত্যার প্রচেষ্টা সংঘটিত হওয়াকে ব্যাহত করা খুবই জরুরী ছিল।

সম্ভাব্য দুটি আত্মহত্যার ঘটনার কথা আমার মনে পড়ে, যার প্রতিটি ঘটনাই এক লক্ষণীয় সাদৃশ্যতা ছিল। উভয় ব্যক্তিই তাদের আত্মহত্যা করার উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমাকে বলেছিল। উভয়েই স্বাভাবিক যুক্তি উপস্থাপন করে বলেছিল যে – জীবন থেকে প্রত্যাশা করার তাদের কিছুই ছিল না। উভয় ঘটনায় জীবন যে তাদের কাছ থেকে এখনও কিছু প্রত্যাশা করছে তা অনুধাবন করিয়ে দেওয়াই ছিল আসল প্রশ্ন। তাদের বুঝিয়ে দেওয়া যে ভবিষ্যতে তাদের কাছ থেকে কিছু প্রত্যাশা করার মতো রয়েছে। বস্তুত, আমরা উদ্ঘাটন করতে পেরেছিলাম যে, একজনের জন্য তার ছেলেই ছিল আত্মহত্যা চেষ্টার কারণ। যে ছেলে সে অত্যন্ত পছন্দ করতো ও যে তার জন্য এক ভিন্ন দেশে অপেক্ষা করছিল। অন্য একজনের ক্ষেত্রে আত্মহত্যা চেষ্টার কারণ ছিল একটি বস্তু, কোনো ব্যক্তি নয়। সেই লোকটি ছিলেন একজন বিজ্ঞানী যে কয়েকটি বইও লিখছিলেন যা তখনও অসমাপ্ত ছিল। অন্য কাউকে দিয়ে যেমন তার কাজ শেষ করা যাবে না, তেমনি সন্তানের ভালবাসায় একজন পিতার স্থান অন্য কেউ কখনও নিতে পারে না।

এই স্বতন্ত্রতা এবং এককত্ব যা প্রত্যেক ব্যক্তিকে আলাদা করে ও তার জীবনের অর্থ প্রদান করে, সৃজনশীল কর্মে তার তাৎপর্য রয়েছে, যতটা তাৎপর্য রয়েছে মানব ভালবাসায়। যখন কোনো ব্যক্তির স্থানে অন্য কোন ব্যক্তিকে স্থলাভিষিক্ত করার অসম্ভাবনাকে উপলব্ধি করা হয়, তখন তা একজন মানুষের জীবনের জন্য এবং এর ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য থাকা দায়বদ্ধতাকে সকল মাত্রায় আবির্ভাবের অনুমতি দেয়। যে ব্যক্তি স্নেহশীলভাবে তার জন্য অপেক্ষায় থাকা এমন একজন মানুষের জন্য সহ্য করা দায়বদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে, বা যে ব্যক্তি তার অসমাপ্ত কাজের অপেক্ষায় থাকে সে কখনও তার জীবনকে বিনষ্ট করতে দেবে না। সে তার অস্তিত্বের পেছনে “why” বা “কেনো” সম্পর্কে অবগত থাকে, আর প্রায় যেকোনো “how” বা “কিভাবে” বা উপায়কে সহ্য করতে সমর্থ হয়।

******

শিবিরে সমষ্টিগত সাইকোথেরাপিউটিক বা মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসার সুযোগ তার ছিল সাধারণত সীমিত। কথার চেয়ে যথাযথ উদাহরণ ছিল অধিকতর কার্যকর। যে সিনিয়র ওয়ার্ডেনটি কর্তৃপক্ষের পক্ষ নেয়নি তার ন্যায়পরায়ণ আর উৎসাহমূলক আচরণের মাধ্যমে তার এখতিয়ারের অধিনে থাকা ব্যক্তিদের উপর সুদূরপ্রসারী নৈতিক প্রভাব বিস্তারের হাজার খানেক সুযোগ ছিল। আচরণের তাৎক্ষনিক প্রভাব সব সময়ই কথার চেয়ে কার্যকর। কিন্তু মাঝে মাঝে কথাও কার্যকর ছিল, যখন মানসিক গ্রহনযোগ্যতা বাহ্যিক পরিপার্শিকতার দ্বারা তীব্রতর হত। একটি ঘটনার কথা আমি স্মরণ করতে পারি যখন পুরো ছাউনির বাহ্যিক এক পরিস্থিতির কারণে কয়েদিদের মানসিক গ্রহনযোগ্যতা তীব্রতর হওয়ার কারণে সাইকোথেরাপিউটিক বা মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসার সুযোগ হয়েছিল।

দিনটি ছিল মন্দ। যেসব কাজকে তখন থেকে নাশকতা হিসেবে বিবেচিত করা হবে আর যার জন্য ঝুলিয়ে তৎক্ষণাৎ মৃত্যুর মাধ্যমে শাস্তি দেওয়া হবে সেসব কাজের বিষয়ে কুচকাওয়াজের সময় ঘোষণা দেওয়া হলো। আর সেসব কাজের মধ্যে অপরাধ হিসেবে ছিল পায়ের গোড়ালিতে ব্যবহার করার জন্য আমাদের পুরনো কম্বল থেকে ছোট টুকরো কাটা এবং ছোট-খাটো “চুরির ঘটনা”। কয়েকদিন আগে এক অর্ধ-অনাহারী ব্যক্তি কয়েক পাউন্ড আলু চুরির উদ্দেশ্যে আলুর গুদামে ঢুকেছিল। চুরির ঘটনাটি আবিষ্কার করা হয়েছিল। আর কয়েকজন বন্দী “চুরটিকেও” চিনতে সমর্থ হয়েছিল। শিবির কর্তৃপক্ষ যখন ঘটনাটি শুনতে পায় তখন তারা অপরাধী লোকটিকে তাদের হাতে তুলে দেওয়ার নির্দেশ দেয়, আর ঘোষণা দেয় যে অন্যথায় পুরো শিবিরকে একদিন অনাহারে থাকতে হবে। স্বভাবতই শিবিরের ২৫০০ কয়েদি উপবাস থাকাকে শ্রেয় মনে করেছিল।

সে উপবাসের দিন সন্ধ্যায় আমরা খুব হতাশ মেজাজে আমাদের মাটির তৈরি ছাউনিতে শুয়েছিলাম। খুব কমই আমরা কথা বলছিলাম আর প্রতিটি বাক্যই তখন খিটখিটে শোনাচ্ছিল। তারপর, বিষয়টিকে আরও খারাপ করে দিয়ে চলে গেলো আলো। মন-মেজাজ সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে গেলো। কিন্তু আমাদের সিনিয়র ব্লক ওয়ার্ডেন ছিলেন একজন বুদ্ধিমান মানুষ। তিনি সে মুহূর্তে আমাদের মনের বিষয়াদি নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে ছোট আলাপ শুরু করে দিয়েছিলেন। গত কয়েক দিনে হয় অসুস্থতায়, না হয় আত্মহত্যা করে মারা যাওয়া অনেক সহকর্মীদের বিষয়ে তিনি অনেক বলেছিলেন। কিন্তু তাদের মৃত্যুর প্রকৃত কারণও তিনি উল্লেখ করেছিলেন: আশা ছেড়ে দেওয়া। তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ ভুক্তভোগীদের এই চরম পরিস্থিতিতে পৌঁছা থেকে রক্ষা করার কোনো উপায় থাকা উচিৎ। আর আমার কাছে মনে হয়েছিল যেন তিনি এই সাইকোথেরাপিউটিক উপদেশ দেওয়ার জন্য আমাকে ইশারা করেছিলেন।

ঈশ্বর জানেন, তখন আমার সহকর্মীদের এক ধরনের আত্মার বা মনের চিকিৎসা সেবা প্রদানের উদ্দেশ্যে মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য বা কোনো ধর্মীয় শিক্ষা প্রদানের জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। আমি তখন শীতার্ত আর ক্ষুধার্ত, খিটখিটে ও ক্লান্ত ছিলাম, কিন্তু আমাকে এই অনুপম সুযোগের সদ্ব্যবহারে প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়েছিল। সবচেয়ে বেশি প্রেরণার এখনই দরকার।

তাই আমি সবার আগে ছোট ছোট আরাম-আয়েশ সমূহ উল্লেখ করে শুরু করেছিলাম। আমি বলেছিলাম যে এই ইউরোপেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৬ষ্ট তম শীতকালে আমাদের অবস্থা আমরা যেমনটা ভেবেছিলাম তার মতো এতটা ভয়াবহ হয়নি। আমি বলেছিলাম যে আমাদের প্রত্যেকের নিজেকে জিজ্ঞেস করতে হবে কোনো অপূরণীয় ক্ষতির তাকে আজ অবধি সম্মুখীন হতে হয়েছে কিনা। আমি ধারণা করে নিয়েছিলাম যে অনেকের জন্য এরকম ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রকৃত অর্থে কম। তখন পর্যন্ত বেঁচে থাকা যেকারও কাছেই আশা-প্রত্যাশার কারণ ছিল। স্বাস্থ্য, পরিবার, সুখ-শান্তি, পেশাগত সামর্থ্য, ভাগ্য, সামাজিক অবস্থান—এসব কিছুই পুনরায় অর্জন করা বা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। সর্বোপরি, আমাদের সকলেরই হাড় ছিল অক্ষত। আমরা যা কিছুরই মধ্য দিয়ে গিয়েছি তা আমাদের জন্য ভবিষ্যতের সম্পদ হতে পারে। আর আমি নিৎশেকে উদ্ধৃতি করলাম: “যা আমাদের মারতে পারে না, তা আমাদের অধিকতর শক্তিশালী করে তুলে”। (That which does not kill me, makes me stronger.)

তারপর আমি ভবিষ্যতের বিষয়ে কথা বলেছিলাম। আমি বলেছিলাম যে ন্যায়পরায়ণ মানুষের কাছে ভবিষ্যৎ অবশ্য হতাশ মনে হয়। আমি সম্মতি দিয়ে বলেছিলাম যে আমাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কতোটা ক্ষীণ ছিল তা আমরা প্রত্যেকে অনুমান করতে পারি। আমি তাদের বলেছিলাম যদিও শিবিরে তখনও কোনো টাইফাস মহামারি দেখা দেয়নি, তবুও প্রতি বিশ জনে একজন হিসেবে আমি আমার নিজের বেচে থাকার সম্ভাবনাকে অনুমান করেছিলাম। কারণ ভবিষ্যৎ তার জন্য কি নিয়ে আসবে তা কেউই জানতো না, তার চেয়ে কম অনিশ্চিত ছিল পরবর্তী মুহূর্তে কি হবে তার সম্ভাবনা। এমনকি আমরা যদি পরবর্তী কয়েক দিনে যুদ্ধ সম্পর্কে কোনো চাঞ্চল্যকর সামরিক ঘটনা প্রত্যাশা নাও করতে পারি, শিবিরে আমাদের অভিজ্ঞতার কারণে কে আমাদের চেয়ে ভালা জানতো যে মাঝে মাঝে আকস্মিকভাবে কোনো ব্যক্তির জন্য কতো বড় সম্ভাবনার দ্বার খুলে গিয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, কেউ হয়তো অপ্রত্যাশিতভাবে বিশেষভাবে কাজের ভালো অবস্থা রয়েছে এমন কোনো বিশেষ দলের প্রতি সংযুক্ত ছিলেন, কারণ এই ধরনে জিনিসই একজন কয়েদির “নিয়তি” গঠন করেছিল।

কিন্তু আমি কেবল ভবিষ্যৎ আর তার সম্ভাবনা হারিয়ে যাওয়ার বিষয়ে কথা বলেছিলাম তা নয়। আমি অতীত সম্পর্কেও কথা বলেছিলাম। কথা বলেছিলাম অতীতের সব আনন্দ, আর কিভাবে তার আলোয় বর্তমান অন্ধকারচ্ছতাকে আলোকিত করেছিল সে সম্পর্কেও। নিজেকে একজন ধর্মপ্রচারকের মতো শুনা থেকে বিরত রাখতে পুনরায় আমি এক কবির উদ্ধৃতি করেছিলাম-যিনি লিখেছিলেন, “তুমি যার অভিজ্ঞতা লাভ করেছো বা শিখেছ, কোনো শক্তিই তা তোমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না”। (What you have experienced, no power on earth can take from you.) কেবল আমাদের অভিজ্ঞতা নয়, বরং আমরা যাই করেছি, যত মহৎ বা মহান ভাবনা আমাদের ছিল, এবং আমরা যে যন্ত্রণাভোগ করেছি, তার কোনো কিছুই হারিয়ে যায়নি, যদিও তা অতীতে রূপান্তরিত হয়েছে। আমরা তাকে এক সত্ত্বা বা অস্তিত্বে রূপ দিয়েছি। গত হয়ে যাওয়া বা অতীত হয়ে যাওয়াও এক ধরনের অস্তিত্ব, আর সম্ভবত সবচেয়ে নিশ্চিত প্রকারের অস্তিত্ব।

তারপর আমি জীবনকে অর্থবহ করে তোলার বহু সুযোগ সম্পর্কে কথা বলেছিলাম। আমি আমার সহকর্মীদের যারা নিথর হয়ে পড়ে থেকেছিল তাদের উল্লেখ করে বলেছিলাম যে, যে কোনও পরিস্থিতিতেও মানব জীবন অর্থহীন হয় না। এবং জীবনের এই ক্ষয়হীন অর্থ’র মাঝে সম্পৃক্ত রয়েছে যন্ত্রণাভোগ ও মৃত্যু বরণ, অভাব ও মৃত্যু। ছাউনির অন্ধকারে দীনহীন হয়ে পড়ে থাকা প্রাণী, যারা আমার কথা মন দিয়ে শুনছিল আমি তাদের আমাদের পরিস্থিতিকে গুরুত্ব সহকারে মোকাবিলা করার আহ্বান করেছিলাম। আমি বলেছিলাম যে, তাদের আশা-প্রত্যাশা হারিয়ে ফেলা উচিৎ নয় বরং এই নিশ্চয়তায় সাহস রাখা প্রয়োজন যে আমাদের সংগ্রামের ব্যর্থতা জীবনের মর্যাদা এবং অর্থ’কে হরণ করেনি। আমি বলেছিলাম যে কঠিন মুহূর্তে কেউ –বন্ধু-বান্ধব, স্ত্রী, মৃত বা জীবিত যে কেউ, অথবা ঈশ্বর – আমাদের প্রত্যেককে অবজ্ঞার চোখে দেখে থাকে, তবে সেও চাইবে না যে আমরা তাকে হতাশ করি। সেও আশা করবে যে কিভাবে মৃত্যুকে বরণ করে নিতে হয় তা জেনে আমরা যেন গৌরবের সাথে আমাদের যন্ত্রণা ভোগ করি – দুর্দশাগ্রস্তভাবে নয়।

আর অবশেষে, আমি আমাদের ত্যাগের বিষয়ে কথা বলেছিলাম, প্রতিটি ক্ষেত্রে যা অর্থবহ ছিল। এই ত্যাগের ধরনের কারণেই সাধারণ বস্তুগত সফলতার জগতে তা অর্থহীন প্রতীয়মান হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে উৎসর্গের অর্থ রয়েছে। খোলাখুলি ভাবেই বলার কারণে আমাদের মাঝে যাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ছিল তারা সহসাই বিষয়টি বুঝতে পেরেছিল। আমি তাদেরকে আমাদের এক সহকর্মীর কথা বলেছিলাম, যে শিবিরে আগমনের পরপরই স্বর্গের সাথে চুক্তি করতে চেষ্টা করেছিলেন যে, তার যন্ত্রণাভোগ ও মৃত্যুর উদ্দেশ্য হবে সে যাদের ভালবেসেছিল তাদের কষ্টদায়ক অবসান থেকে বাঁচানো। এই লোকটির জন্য যন্ত্রণাভোগ ও মৃত্যু ছিল অর্থবহ; তার ত্যাগ ছিল গভীরতম তাৎপর্যের। তিনি নিষ্ফল কোনো কিছুর জন্য প্রাণ দিতে চাননি। আমরা কেউই তা চাই না।

তখনও সেখানে সেই ছাউনিতে এবং সেই বাস্তবিকপক্ষে হতাশ মুহূর্তে আমার কথার উদ্দেশ্য ছিল আমাদের জীবনের পরিপূর্ণ অর্থ খুঁজে পাওয়া। আমি লক্ষ করেছিলাম যে আমার প্রচেষ্টা সফল হচ্ছিল। যখন বৈদ্যুতিক বাল্ব আবার জ্বলে ওঠে, আমি দেখলাম আমার বন্ধুদের হতাশাগ্রস্ত দেহ সমূহ খুড়াতে খুড়াতে তাদের অশ্রুসজল নয়নে আমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছে। কিন্তু এখানে আমাকে স্বীকার করতে হবে যে, যন্ত্রণাভোগ করা আমার সঙ্গীদের সাথে আমার যোগাযোগ করার খুব কমই আভ্যন্তরীণ শক্তি (Inner strength) ছিল এবং তা করতে গিয়ে আমার হয়তো অনেক সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল।

*********

আমরা এখন কয়েদিদের মানসিক প্রতিক্রিয়ার তৃতীয় স্তর সম্পর্কে কথা বলব। আর তাহলো কোনো কয়েদির মুক্তির পর তার মানসিক অবস্থা। কিন্তু তার পূর্বে আমরা প্রায়শই মনস্তাত্ত্বিকদের দ্বারা করা প্রশ্নটি বিবেচনায় আনবো, বিশেষত যখন শিবিরের এসব বিষয়ে কোনো কয়েদির ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থাকে। প্রশ্নটি হলো: শিবির প্রহরীদের মানসিক স্বভাব সম্বন্ধে আপনি আমাদের কি বলতে পারি? অসংখ্য কয়েদিদের অভিযোগ অনুযায়ী, কিভাবে সেসব রক্ত-মাংসের মানুষদের পক্ষে অসংখ্য কয়েদিদের সাথে এরকম আচরণ করা সম্ভব হয়েছিল? এক সময় এসব বর্ণনা শুনে ও এসব জিনিস যে ঘটেছিল তা বিশ্বাস করে একজন মানুষ, মনস্তাত্ত্বিকভাবে বা মানসিকভাবে তা কিভাবে সম্ভব হতে পারে তা জানতে চাইবে। এ প্রশ্নের উত্তর দিতে বিষদ বর্ণনায় না গিয়ে আমাদের কয়েকটি বিষয় চিহ্নিত করা দরকার:

প্রথমত, প্রহরীদের মাঝে কেউ কেউ ধর্ষকামী বা স্যাডিস্ট লোক ছিল। যাদের সম্পূর্ণ ক্লিনিক্যাল অর্থে ধর্ষকামী বলা যেতে পারে।

দ্বিতীয়ত, এই ধর্ষকামীদের সব সময়ই বাছাই করে নেওয়া হত যখন সত্যিই তীব্রভাবে প্রহরী সৈন্যদলের প্রয়োজন হত।

তীব্র ঠাণ্ডায় দু’ঘণ্টা কাজ করার পর কয়েক মিনিটের জন্য ডাল-পালা আর কাঠের টুকরোতে ভর্তি ছোট একটি চুলার সামনে নিজেদের উষ্ণ করে তোলার অনুমতি থাকলে আমাদের কাজের স্থলে মহা আনন্দ থাকতো। কিন্তু কিছু কিছু দল প্রধান তা আমাদের কাছ থেকে নিয়ে যাওয়ার মাঝে মহা আনন্দ পেতেন। কত পরিষ্কারভাবেই না তাদের সেই আনন্দ তাদের চেহারায় প্রতিফলিত হতো যখন তারা কেবল আমাদের নিষেধ করেই ক্ষান্ত না হয়ে বরং চুলাটিকে উল্টিয়ে দিয়ে তার আনন্দদায়ক আগুন বরফের মধ্যে ফেলে দিতো! SS এর লোকেরা যখন কোনো লোককে অপছন্দ করতো তখন তাদের সারিতে সব সময়ই ধর্ষকামী নির্যাতনে অভিজ্ঞ ও ধর্ষকামী নির্যাতনে অনুমতি দেওয়া হয়েছে এমন একজন বিশেষ মানুষ থাকতো আর দুর্ভাগা কয়েদিকে তার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হতো।

তৃতীয়ত, বছরের পর বছর ক্রমবর্ধমান মাত্রায় ক্যাম্পের নির্মম পদ্ধতি দেখতে দেখতে অধিকাংশ প্রহরীদের অনুভূতি অসাড় বা ভোঁতা হয়ে গিয়েছিল। নৈতিকভাবে ও মানসিকভাবে কঠোর হয়ে উঠা এই মানুষগুলি ধর্ষকামী নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় অংশগ্রহণে অন্তত অস্বীকৃতি জানাত। কিন্তু তারা ধর্ষকামী নির্যাতন চালিয়ে যাওয়া মানুষগুলিকে বাধা দেয়নি। 

চতুর্থত, এটি স্বীকার করতে হবে যে এমনকি প্রহরীদের মাঝেও এমন লোক ছিল যারা আমাদের প্রতি দয়া দেখাত। আমি এক্ষেত্রে যে শিবির থেকে আমাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল সে শিবিরের অধিনায়কের কথা উল্লেখ করতে পারি। মুক্তির পর বুঝতে পারি যে সে লোকটি নিকটতম বাজার থেকে কয়েদিদের জন্য ঔষধ ক্রয় করতে নিজের পকেট থেকে বড় অঙ্কের অর্থ পরিশোধ করেছিলেন। কেবল একজন ক্যাম্প চিকিৎসকই আগে থেকে তা জানতেন, যে নিজেও ছিলেন একজন কয়েদি। কিন্তু আমাদের সিনিয়র ওয়ার্ডেন যিনি নিজেও একজন কয়েদী ছিলেন, তিনি যেকোনো SS প্রহরীদের চেয়ে কঠোর ছিলেন। তিনি হালকা সুযোগ ফেলেই অন্যান্য কয়েদিদের মারধর করতেন। যেখানে আমার অভিজ্ঞতায় শিবির অধিনায়ক, কখনও আমাদের বিরুদ্ধে হাত তোলেন নি।

একটি বিষয় পরিষ্কার যে, একজন ব্যক্তির শিবির প্রহরী বা একজন কয়েদী হয়ে উঠা সম্পর্কে বলতে গেলে আমাদের কিছুই ধারণা দেয় না। মানবিকতা সকল দলের মানুষের মাঝে বিদ্যমান, এমনকি সার্বিকভাবে যাদের সহজেই দোষারোপ করা যায় তাদের মাঝেও। মানুষের মাঝে মানবিকতার সীমানা একদল থেকে অন্য দলে ছড়িয়ে পড়েছে এবং এই লোকগুলি ফেরেশতার মতো বা ঐসব লোকগুলি শয়তানের মতো বলে বিষয়গুলিকে সহজসাধ্য করার চেষ্টা করতে নেই। নিঃসন্দেহে, একজন প্রহরীর জন্য বা একজন কাজের দলনেতার পক্ষে শিবিরের সমস্ত প্রভাব সত্ত্বেও কয়েদিদের প্রতি দয়াবান হওয়াটা এক উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব। আর অন্যদিকে, একজন কয়েদি যে তার নিজের সঙ্গীদের প্রতি নির্মম আচরণ করেছিল তার হীনতা বা অপকর্ম ছিল অতি নিকৃষ্ট। দৃশ্যত, কয়েদিদের জন্য এরকম মানুষদের চরিত্রহীনতা ছিল বিশেষভাবে উদ্বেগজনক, যেখানে কোনো প্রহরী কর্তৃক ক্ষুদ্রতম উদারতা তাদের গভীরভাবে নাড়া দিতো। আমার মনে পড়ে একজন দল প্রধানের কথা যে একদিন গোপনে আমাকে একটুকরো রুট দিয়েছিলেন। আমি জানতাম তিনি নিশ্চয় তা তার সকালের নাস্তার বরাদ্দ থেকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। সে সময় যে জিনিসটি আমার চোখে জল এনেছিল তা সে ছোট রুটির টুকরোটি নয়। তা ছিল মানবিক ‘একটা-কিছু’ যা এই লোকটি আমাকে দিয়েছিলেন, আর তা ছিল উপহারের সাথে আসা তার বাক্য ও চাহনি।

Similar Posts