Last updated on January 24th, 2024 at 02:19 pm
এসব থেকে আমরা শিখতে পারি যে, পৃথিবীতে মানুষের দু’টি জাত রয়েছ, কেবল এই দুই জাত – শালীন (decent) মানুষের “জাত” এবং অশালীন (indecent) মানুষের “জাত”। উভয় জাতেরই সবখানে অস্তিত্ব রয়েছে; এই জাত দুটি সমাজের সকল দলে প্রবেশ করে। নির্দিষ্ট কোনো দলই কেবল শালীন বা অশালীন মানুষ দিয়ে গঠিত নয়। এই অর্থে, কোনো দলকেই আমরা “শুদ্ধ জাত” বলতে পারি না- আর তাই কেউ মাঝে মধ্যে শিবিরের প্রহরীদের মাঝেও একজন শালীন মানুষকে খুঁজে পেতো।
বন্দী শিবিরের জীবন মানুষের আত্মাকে ছিঁড়ে উন্মুক্ত করে দিয়েছিল এবং এর গভীরতাকে উদ্ভাসিত করেছিল। সেই গভীরতায় আবার কেবল মানুষের গুণাবলীকে খুঁজে পাওয়া কি আশ্চর্যের কিছু যা প্রকৃতপক্ষে ভালো আর মন্দের মিশ্রণ? মন্দ থেকে ভালোকে পৃথক করা ফাটলটি সকল মানুষকে ভেদ করে সর্ব নিম্ন স্তরে পৌঁছে গিয়েছে আর তা বন্দী শিবির দ্বারা উন্মুক্ত রাখা অতল গহ্বরের তলদেশেও দৃশ্যমান হয়ে উঠে।
*******
আর এখন শেষ অধ্যায়ে রয়েছে মুক্ত হওয়া কয়েদির মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে। মুক্তির ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে বর্ণনা করতে, কয়েকটি অত্যন্ত উত্তেজনাপূর্ণ দিনের পর শিবিরের প্রবেশ ধারের উপরে সাদা পতাকা উড্ডয়নের যে সকালের কথা বলা হয়েছে, সেখান থেকে আমরা আমাদের বর্ণনার অংশটি শুরু করবো। এই অভ্যন্তরীণ উদ্বেগের পর এসেছিল পরিপূর্ণ স্বস্তি। কিন্তু এটা ভাবা কি বেশ অন্যায় হবে যে আনন্দের সাথে আমরা পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। তখন আসলে কি হয়েছিল?
ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত পদক্ষেপে আমরা কয়েদিরা নিজেদেরে শিবিরের প্রবেশ ধার পর্যন্ত টেনে নিয়ে গিয়েছিলাম। ভয়ে ভয়ে আমরা চারদিকে দেখলাম আর জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে একে অন্যের পানে তাকালাম। তারপর আমরা সাহস করে শিবিরের বাইরে কয়েক পা এগিয়ে গেলাম। এসময় কোনো চিৎকার করা আদেশ আমাদের দেওয়া হয়নি, প্রয়োজন হয়নি দ্রুত মাথা নিচু করে আঘাত বা লাথি থেকে বাঁচার প্রচেষ্টা করার। হা হা! এখন দেখি প্রহরীরাও আমাদের সিগারেট সাধছে! প্রথম প্রথম আমরা তাদের চিনতেই পারিনি। তড়িঘড়ি করে তারা বেসামরিক পোশাকে পরিবর্তিত হয়ে পড়েছিল। শিবির থেকে বয়ে যাওয়া সড়ক ধরে আমরা ধীরে ধীরে হাঁটছিলাম। শীঘ্রই আমাদের পা ব্যথা করছিল ও বেঁকে যাওয়ার মতো অবস্থা হলো। কিন্তু তারপরও আমরা খুড়িয়ে হাটতে থাকলাম; মুক্ত মানুষের চোখে আমরা প্রথমবারের মতো শিবিরের চারপাশ দেখতে চাইলাম। নিজেদের কাছে “মুক্তি” বা স্বাধীনতা শব্দটি কথায় কথায় পুনরাবৃত্তি করলাম, আর তবুও শব্দটিকে উপলব্ধি করতে পারলাম না। এই কয়েক বছরে স্বপ্ন দেখা শব্দটিকে নিয়ে আমরা অসংখ্যবার কথা বলেছিলাম, যে শব্দটি তার অর্থ হারিয়ে ফেলেছিল তখন। শব্দটির বাস্তবতা আমাদের চেতনায় প্রবেশ করেনি। আমরা বুঝতে পারিনি যে আমরা আসলেই মুক্ত হয়েছিলাম।
আমরা ফুলে পরিপূর্ণ এক তৃণভূমিতে আসলাম। আমরা দেখলাম আর অনুধাবন করলাম যে, যার যেখানে থাকার কথা সেখানে সবকিছুই। কিন্তু তাদের সম্পর্কে আমাদের কোনো অনুভূতিই ছিল না। বহুরঙা পালকের লেজ নিয়ে একটি মোরগ আমাদের চোখে পড়তেই আমাদের প্রথম আনন্দের ঝলকানি হয়। কিন্তু তা কেবল এক ঝলকানিতে শেষ হয়ে যায়। আমরা তখনও এই জগতের অন্তর্ভুক্ত হতে পারিনি।
সন্ধ্যায় আমরা পুনরায় ছাউনিতে মিলিত হলাম, কেউ কেউ গোপনে একে অন্যকে বলেছিল, “আমাকে বলুন তো, আপনি কি আজকে আনন্দিত ছিলেন?”
যেহেতু সে জানতো না যে আমরাও একই জিনিস অনুভব করছিলাম তাই লজ্জিত হয়ে অন্যজন উত্তর দেয়, “সত্যিকার অর্থে, না”! আমরা আক্ষরিক অর্থে আনন্দিত অনুভব করার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছিলাম। আর সে অনুভূতি আমাদেরকে ক্রমে ক্রমে পুনরায় অর্জন করতে হয়েছিল।
********
মনস্তাত্ত্বিকভাবে, মুক্ত কয়েদিদের ক্ষেত্রে যা ঘটছিল তাকে “depersonalization” বলা যেতে পারে। এটি এমন এক মানসিক অবস্থা যাতে কারো চিন্তা-ভাবনা এবং অনুভূতিকে অবাস্তব মনে হয় বা নিজের কাছে অন্তর্ভুক্ত বলে মনে হয় না। স্বপ্নের মতো সবকিছুকেই মনে হয়েছিল অবাস্তব, অসম্ভব। আমরা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে তা সত্যি। বিগত বছরগুলিতে কত বারই না আমরা স্বপ্নের দ্বারা প্রতারিত হয়েছিলাম! আমরা স্বপ্ন দেখতাম যে মুক্তির দিন এসে গেছে, আমাদের অবমুক্ত করা হয়েছে, আমরা বাড়ি ফিরে গিয়েছি, আমাদের বন্ধু-বান্ধবদের অভিবাদন জানিয়েছি, আমাদের স্ত্রীদের আলিঙ্গন করেছি, টেবিলে বসে পড়েছি ও আমরা যেসবের মধ্যদিয়ে গিয়েছি তা বলতে শুরু করে দিয়েছি – এমনকি কতবার আমাদের এই মুক্তির দিনটি নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলাম। আর তখনই আমাদের কানে একটি বাঁশি কর্কশভাবে বেজে উঠলো, জেগে উঠার সঙ্কেত। আমাদের স্বপ্নের সমাপ্তি ঘটে। আর এখন স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। কিন্তু তাতে কি সত্যিই বিশ্বাস করতে পেরেছিলাম?
*******
মনের চেয়ে দেহের কম inhibition বা আভ্যাসিক সংকোচন বা নিগ্রহ রয়েছে। প্রথম মুহূর্ত থেকেই তা (দেহ) নতুন মুক্তি বা স্বাধীনকে সুসম ব্যবহার করেছিল। তা রাক্ষসের মতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা এবং দিনের পর দিন এমনকি অর্ধেক রাত পর্যন্ত খাওয়া শুরু করে দিয়েছিল। একজন মানুষ কি পরিমাণে যে খেতে পারে তা বিস্ময়কর। পাড়ার কোনো বন্ধু সুলভ কৃষক যখন কোনো কয়েদিকে নিমন্ত্রণ করতো, তখন সে খেতেই থাকতো ও কফি পান করতেই থাকতো, যা তার জিহ্বাকে ঢিলা করে দিতো আর সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতে থাকতো। বছর বছর ধরে যে চাপ তার মনের উপর ছিল তা অবশেষে মুক্ত করা হতো। তাকে কথা বলতে শুনে, একজন মানুষ ধারনা করতে পারতো যে লোকটির কথা বলা দরকার, আর তার কথা বলার আকাঙ্ক্ষা ছিল অপ্রতিরোধ্য। আমি এমন সব লোকদের সম্পর্কে জানতে পেরেছি যারা কেবল অল্প সময়ের জন্য জার্মান পুলিশদের মাধ্যমে জেরা করার ন্যায় একই প্রতিক্রিয়া করার জন্য প্রচণ্ড চাপের মধ্যে ছিল। অনেক দিন পার হয়ে যাওয়ার পর যে শুধু জিহ্বা ঢিলা হয়ে গিয়েছিল তা নয়, বরং নিজের মাঝে অন্য কিছুও ঢিলা হয়ে উঠেছিল। তারপর একদিন হঠাৎ করে তাকে প্রতিরোধ করে রাখা অদ্ভুত শিকল ছিঁড়ে অনুভূতি বের হয়ে পড়ে।
*******
আমাদের মুক্তির কয়েকদিন পর আমি গ্রামের মধ্য দিয়ে মাইলের পর মাইল ফুলে ভরা তৃণভূমি পার হয়ে শিবিরের পার্শ্ববর্তী শহরের বাজারের দিকে হাঁটছিলাম। ভরত পাখিগুলি আকাশে উড়ছিল আমি তাদের উৎফুল্ল গান শুনতে পেয়েছিলাম। কয়েক মাইলের ভেতরে চারপাশে দেখার মতো কেউই ছিল না; বিস্তীর্ণ ধরা আর আকাশ এবং ভরত পাখিদের উল্লাস আর অবকাশের স্বাধীনতা ব্যতীত আর কিছুই ছিল না। আমি থামলাম, চার দিকে এবং উপরে আকাশের দিকে তাকালাম – আর তারপর আমি হাঁটু গেড়ে বসলাম। সে মুহূর্তে খুব কমই আমার নিজের বা পৃথিবীর পরিচিত কিছু ছিল – আমার মনে বরাবরের মতো একটি বাক্যই ছিল: “সংক্ষীর্ণ হাজত থেকে আমি প্রভুকে ডেকেছিলাম আর অবকাশের স্বাধীনতায় (freedom of space বা অবস্থানগত স্বাধীনতা) তিনি সাড়া দিলেন”। কতক্ষণ আমি সেখানে হাটুঁ গেড়ে ছিলাম এবং বাক্যটির পুনরাবৃত্তি করছিলাম তা স্মৃতিশক্তি আর মনে করতে পারে না। কিন্তু আমি জানি যে সেদিন, সেই মুহূর্তে আমার নবজীবনের শুরু হয়েছিল। যতক্ষণ না আমি পুনরায় একজন মানুষ হয়ে উঠলাম ততক্ষণ পদক্ষেপের পর পদক্ষেপে আমি ধাবিত হলাম।
******
শিবিরের শেষ দিনগুলির তীব্র মানসিক উত্তেজনা থেকে সেই (স্নায়ু যুদ্ধ থেকে মানসিক শান্তির দিকে) অগ্রসর হওয়া পথটি অবশ্যই বাধা-বিপত্তিহীন ছিল না। এটা চিন্তা করা ভুল হবে যে একজন মুক্ত বা স্বাধীন কয়েদির আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্যের আর প্রয়োজন ছিল না। আমাদের বিবেচনা করতে হবে যে একজন মানুষ যে দীর্ঘ সময় ধরে এরকম প্রকাণ্ড মানসিক চাপের মধ্যে থাকে, মুক্তির পর সে স্বভাবতই তার কিছু ঝুঁকিতে থাকে। বিশেষ করে যখন সে চাপকে বেশ হঠাৎ করেই বিমুক্ত করা হতো। মনস্তাত্ত্বিক স্বাস্থ্যের বেলায় এই বিপদ হলো বক্রতার মনস্তাত্ত্বিক প্রতিমূর্তি। সেতু ইত্যাদির ভিত্তি স্থাপনকালে জলের নিচে কাজ করার জল নিবারক বৃহৎ বাক্স বা প্রকোষ্ঠের (caisson) শ্রমিকের দৈহিক স্বাস্থ্য বিপদগ্রস্ত হবে যদি সে হঠাৎ করে ডুবুরির চেম্বার বা প্রকোষ্ঠ থেকে (যেখানে সে প্রচুর atmospheric pressure বা বায়ুমণ্ডলীয় চাপের মধ্যে থাকে) বের হয়ে আসে, তাই হঠাৎ করে মানসিক চাপ মুক্ত হওয়া বা স্বাধীনতা পাওয়া মানুষটি নৈতিক ও আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্যের ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে।
এই মনস্তাত্ত্বিক বা মানসিক অবস্থার সময় লক্ষ্য করা যায় যে অধিকতর আদিম প্রকৃতির মানুষেরা শিবির জীবনে ঘিরে থাকা নির্মমতার প্রভাব থেকে রেহাই পেতনা। মুক্ত অবস্থায়, তারা মনে করেছিল তারা তাদের স্বাধীনতাকে “উচ্ছৃঙ্খলভাবে ও নির্মমভাবে” ব্যবহার করতে পারবে। শুধুমাত্র যে জিনিসটি তাদের কাছে পরিবর্তিত হয়েছিল তা ছিল নিপীড়িত হওয়ার চেয়ে তারা হয়ে উঠেছিল নিপীড়নকারী। তারা স্বেচ্ছাচারী শক্তি ও অবিচারের বস্তু না হয়ে, হয়ে উঠেছিল এর উস্কানি দাতা। তারা তাদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার দ্বারা তাদের আচরণকে বিচার বা সমর্থন করেছিল। তা প্রায়শই দৃশ্যমান হতো তুচ্ছ ঘটনায়। আমার এক বন্ধু আমার সাথে একটি মাঠের মধ্য দিয়ে শিবিরের দিকে হাঁটছিল। হাটতে হাটতে আমরা হঠাৎ এক সবুজ ফসলী মাঠের কাছে চলে আসি। আপনা আপনিতেই, তা আমি এড়িয়ে চললাম, কিন্তু সে আমার বাহুর ভেতর দিয়ে তার বাহু বাড়িয়ে দিয়ে মাঠটির ফসলের মধ্য দিয়ে আমাকে টেনে নিয়ে গেলো। কচি শস্য পদদলিত না করার বিষয়ে আমি কিছু বিড়বিড় করে কিছু একটা বলেছিলাম। সে বিরক্ত হলো, রাগান্বিত ভাব আমার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল, “কি বলো এসব! আর আমাদের কাছ থেকে কি যথেষ্ট কেড়ে নেওয়া হয়নি? আমার স্ত্রী আর বাচ্চাকে গ্যাস দিয়ে মারা হয়েছে – অন্য সবকিছু আর নাই বললাম – আর তুমি আমাকে এই কয়েকটি যবের বৃন্ত মাড়াতে নিষেধ করবে”!
এসব লোকদের কেবল ধীরে ধীরে প্রচলিত সত্যে ফিরিয়ে আনা সম্ভব যে, অন্যায় করার কারো অধিকার নেই, এমনকি তাদের সাথে যদি অন্যায়ও করা হয়ে থাকে তখনও না। তাদের এই সত্যে চালিত করতে আমাদের প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়েছিল, নতুবা তার পরিণতি কয়েক হাজার যবের বৃন্ত হারানোর চেয়ে অধিক খারাপ হতো। আমি এখনও এক বন্দীকে দেখি যে তার জামার হাতা গুটিয়ে তার ডান হাত আমার নাকের নিচে ঠেলে ধরে রেখে চিৎকার করে বলতো, “এই হাত যেন কেটে ফেলা হয় আমি যদি বাড়িতে পৌঁছার দিন তা রক্তে রঞ্জিত না করি”! আমি বিশেষভাবে বলতে চাই যে, যে লোকটি এসব কথা বলেছিল সে একজন মন্দ লোক ছিল না। শিবিরে ও পরবর্তী কালে সে ছিল সহকর্মীদের মাঝে সর্বোত্তম ব্যক্তি।
মানসিক চাপের আকস্মিক নিস্তারের ফলে নৈতিক বিকলাঙ্গতার পাশাপাশি, আরও দু’টি মৌলিক অভিজ্ঞতা মুক্ত কয়েদিদের চরিত্রকে ক্ষতি সাধনের হুমকির মুখোমুখি করে: অতীত জীবনে ফিরে যাওয়ার পর তিক্ততা এবং মোহমুক্তি।
তার আগের নিজ শহরে বেশ কিছু জিনিসের বিরুদ্ধে তার অবস্থান নেওয়া থেকে তিক্ততার সৃষ্টি হতো। শিবির থেকে ফিরে আসার সময় যখন একজন কয়েদি দেখতে পেত সে অনেক জায়গায় কাঁধ কুঁচকানো বা উদাসীনতা আর বহুলব্যবহৃত বুলির মুখোমুখি হচ্ছে। তখন সে তিক্ততা প্রবণ হয়ে উঠে ও নিজেকে জিজ্ঞেস করে ‘কেনো তাকে ক্যাম্পে সে সবের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল’। যখন সে প্রায় সবখানেই একই কথা শুনতে পায়, “আমরা তো তা জানতাম না” এবং “আমরাও কষ্ট ভোগ করেছি”, তখন সে নিজেকে জিজ্ঞেস করে, তাদের কি আসলেই এর চেয়ে ভালো কিছু আমাকে বলার জন্য নেই?
মোহমুক্তি বা হতাশার অভিজ্ঞতা আলাদা। এ পর্যায়ে এটি কারো সহকর্মী মানুষকে নয় বরং ভাগ্যকেই নিষ্ঠুর বলে মনে হয়েছিল। তার উপলব্ধিহীনতা ও অনুভূতিহীনতা এতটাই ঘৃণ্য ছিল যে অবশেষে লোকজনের কথা না শোনে বা তাদের না দেখে চুপিসারে কেউ নিজেকে গর্তে ঢুকিয়ে রাখার মতো অনুভব করতো। একজন মানুষ, যে বছর বছর ধরে ভেবেছিলো যে সে হয়তো সকল সম্ভাব্য যন্ত্রণা ভোগের একেবারে চরম সীমানায় পৌঁছেছে, সে মুক্ত হওয়ার পর বুঝতে পারে যে যন্ত্রণা ভোগের কোনো শেষ নাই। এখনও আরও যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে, আর ভোগ করতে হবে আরও তীব্রভাবে।
শিবিরে একজন মানুষকে মানসিক সাহস দেওয়ার প্রচেষ্টার ব্যাপারে যখন আমরা কথা বলেছিলাম, আমরা বলেছিলাম যে তাকে ভবিষ্যতে প্রত্যাশা করার জন্য কিছু একটা দেখানো উচিৎ। তাকে স্মরণ করিয়ে দিতে হয়েছিল যে জীবন এখনও তার জন্য অপেক্ষা করছে, ও কেউ একজন মানুষ তার অপেক্ষায় আছে। কিন্তু মুক্তির পর কি হয়েছিল? এমনও অনেক লোক ছিল মুক্তির পর যারা আবিষ্কার করেছিল যে আসলে তাদের জন্য কেউই অপেক্ষা করছিলো না। দুর্ভাগা সে, যে আবিষ্কার করেছিল যে যার স্মৃতি তাকে শিবিরে সাহস যুগিয়েছিল সে আর বেঁচে নেই! দুর্ভাগা সে, যে, অবশেষে যখন স্বপ্নের দিনটি আসে, বুঝতে পেরেছিল যে, সে যেসবের জন্য আকুল আকাঙ্ক্ষায় দিন কাটিয়েছিল তার সবকিছুই অনেক আলাদা। সম্ভবত সে কোনো ট্রলি বাসে চড়ে যে বাড়িটি সে কয়েক বছর ধরে তার মানসপটে দেখেছিল সেখানে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো, ও ঠিক যেমনটি সহস্র স্বপ্নে সে করতে আকাঙ্ক্ষিত ছিল ঠিক সেইভাবে ঘরের ঘণ্টা চাপে, আর তারপর বুঝতে পারে যে যাকে দরজাটা খুলার কথা ছিল সে সেখানে নেই বা কখনও ফিরে আসার সম্ভাবনাও নাই।
শিবিরে আমরা সবাই একে অপরকে বলেছিলাম যে পৃথিবীর কোনো সুখই আমরা যা ভোগ করেছিলাম তার বিনিময় দিতে পারবে না। আমরা সুখের প্রত্যাশা করছিলাম না – কারণ আমাদের সাহসের সাথে ও আমাদের যন্ত্রণা ভোগে, আমাদের বিসর্জনে আর মৃত্যুতে অর্থ প্রদানের পেছনে সুখের কোনো সংযোগ ছিল না। তথাপি, আমরা কেউই অশান্তির জন্যও প্রস্তুত ছিলাম না। এই মোহমুক্তি বা হতাশা, যা কয়েদিদের একটি বড় অংশের জন্য অপেক্ষায় ছিল তা এমন এক অভিজ্ঞতা যা এই মানুষগুলির পক্ষে অতিক্রম করা খুবই কষ্টসাধ্য ছিল। এবং যা তাদের কাটিয়ে উঠার জন্য সাহায্য করার ক্ষেত্রে একজন মনঃরোগ বিশেষজ্ঞের পক্ষেও ছিল খুবই কষ্টকর। কিন্তু তার কাছে যেন এটি নিরুৎসাহের কারণ না হয়ে উঠে; অপরপক্ষে, এটি যেন এক বাড়তি কর্মপ্রেরণার সরবরাহ করে।
কিন্তু প্রত্যেক মুক্তিপ্রাপ্ত কয়েদির জন্য এমন এক দিন আসে যখন তার শিবির অভিজ্ঞতার দিকে ফিরে তাকাতে গেলে সে আর বুঝতে পারে না কিভাবে সে এতসব সহ্য করেছিল। অবশেষে তার মুক্তি বা স্বাধীনতার দিনটি আসে, যখন তার কাছে সবই এক সুন্দর স্বপ্নের ন্যায় মনে হয়। তদুপরি, এমনও এক দিন তার জন্য আসে যখন তার কাছে তার সব শিবির অবিজ্ঞতা কেবল এক দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। একজন ঘরে ফেরা মানুষের জন্য সমস্ত পুর্ণতাদায়ক অভিজ্ঞতার অপূর্ব অনুভূতি হলো যে সকল যন্ত্রণা ভোগ শেষে তার জন্য আর ভয় পাওয়ার কিছুই নেই – ঈশ্বর ব্যতীত।
Comments are closed.