man's search for meaning Bangla translation

Man’s Search for Meaning Bangla-ম্যান্স সার্চ ফর মিনিং জীবন বদলে দেওয়া Inspiring বইয়ের বাংলা অনুবাদ 2023

Last updated on January 24th, 2024 at 02:19 pm

দ্বিতীয় অংশ

সংক্ষেপে লগোথেরাপি*

*এই অংশটি প্রথমে Basic Concepts of Logotherapy বা লেগোথেরাপির মৌলিক ধারণা” হিসেবে Man’s Search for Meaning এর ১৯৬২ সংস্করণে প্রকাশিত হয়েছিল যাকে সংশোধিত ও হালনাগাদ করা হয়েছে।

আমার সংক্ষিপ্ত জীবনীমূলক কাহিনীর পাঠকেরা সাধারণত আমার চিকিৎসাবিদ্যা তত্ত্বের এক পূর্ণাঙ্গ ও আরও সিধাসিধি ব্যাখ্যা চেয়েছেন। ফলে, লগোথেরাপির উপর From Death-Camp to Existentialism বা মৃত্যু-শিবির থেকে অস্তিত্ববাদ এর মূল সংস্করণে সাথে আমি সংক্ষিপ্ত একটি অংশ সংযুক্ত করেছিলাম। তবুও তা যথেষ্ট ছিল না, আর আরও একটু বর্ধিত বর্ণনার জন্য আসা অনুরোধ আমাকে অবরুদ্ধ করে ফেলে। তাই, বর্তমান সংস্করণে আমি আমার বর্ণনা সম্পূর্ণরূপে পুনরায়  লিখলাম এবং প্রচুরভাবে সম্প্রসারিত করলাম।

কাজটি সহজ ছিল না। জার্মান ভাষায় লিখিত বিশ খণ্ডের সকল উপাদান সংক্ষিপ্ত পরিসরে পাঠকের কাছে তুলে ধরা অনেকটা হতাশ হওয়ার মতো কাজ। আমার মনে পড়ে একজন আমেরিকান ডাক্তার যে এক সময় ভিয়েনাতে আমার অফিসে এসে হাজির হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “ডাক্তার সাহেব আপনি এখন একজন মনঃসমীক্ষণবিদ”?  সে প্রশ্নে আমি উত্তর দিয়েছিলাম, “ঠিক মনঃসমীক্ষণবিদ নয়”। তারপর তিনি আমাকে প্রশ্ন করতে থাকলেন: “আপনি কোন্ ধারার অনুসারী”? আমি উত্তর দিলাম, “এটি আমার নিজেরই তত্ত্ব বা থিওরি; একে বলা হয় লগোথেরাপি”। আপনি কি আপনাকে এক বাক্যে বলতে পারবেন লগোথেরাপি মানে কি”? তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন। “অন্তত, psychoanalysis বা মনঃসমীক্ষণ ও লগোথেরাপির মধ্যে পার্থক্য কি”? “জি”, আমি বললাম, কিন্তু প্রথমেই আপনি কি আমাকে এক বাক্যে বলতে পারবেন psychoanalysis বা মনঃসমীক্ষণের সারমর্ম কি? এটা ছিল তার উত্তর: মনঃসমীক্ষণের সময় রোগীকে অবশ্যই কোনো শয্যায় শুয়ে পড়তে হয় এবং আপনার কাছে এমন কিছু বলতে হয় যা বলা খুবই  অনুপযোগী”। তারপর আমি তাৎক্ষনিকভাবে নিম্নোক্ত উত্তরে তার যথাযথ উত্তর দেয়: “এখন, লগোথেরাপির বেলায় রোগীটি হয়তো সোজা হয়ে বসে থাকতে পারে কিন্তু তাকে এমন কিছু অবশ্যই শুনতে হয় যা মাঝে মাঝে শুনতে খুবই অনুপযোগী”।

তা অবশ্য, হাসি-তামাশার মাধ্যমে বোঝানো হয়েছিল এবং লগোথেরাপির ক্যাপসুল সংস্করণ হিসেবে নয়। যাইহোক, এতে কিছু রয়েছে, যেহেতু মনো-বিশ্লেষণের তুলনায় লগোথেরাপি হচ্ছে কম অতীত-পর্যালোচনামূলক (retrospective) ও কম অন্তর্বীক্ষণিক (introspective) ( নিজের ভাবনা বা অনুভূতির বিষয়ে প্রচুর চিন্তা করা) একটি পদ্ধতি। লগোথেরাপি বরং ভবিষ্যতের দিকে নজর দেয়, তা বলতে গেলে, রোগীর দ্বারা তার ভবিষ্যতে জীবনের অর্থ পরিপূর্ণ করার দিকে নজর দেয়। (লগোথেরাপি হলো, প্রকৃতপক্ষে, এক অর্থ-কেন্দ্রিক সাইকোথেরাপি বা মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা)। একই সময়, লগোথেরাপি সকল দুষ্টচক্র (vicious-circle) গঠন ও feedback mechanism (এক বক্রাক্ষর প্রণালী যাতে প্রণালী বিঘ্ন সৃষ্টির প্রতি হয় একই দিকে নতুবা বিপরীত দিকে প্রতিক্রিয়া করে) যা স্নায়ু-বৈকল্য (neurosis) বিকাশে বড় ভূমিকা পালনকে অ-কেন্দ্রীভূত করে। এভাবে, স্নায়ুবৈকল্যগ্রস্ত ব্যক্তির সাধারণ আত্মকেন্দ্রিকতাকে ক্রমাগতভাবে লালন ও দৃঢ়তর করার পরিবর্তে চূর্ণ করা হয়।

নিশ্চিন্তে, এধরনের বিবৃতি একটি অতি-সরলীকরণ; তবুও লগোথেরাপিতে রোগীকে প্রকৃতপক্ষে তার জীবনের অর্থের সম্মুখীন এবং তার পানে পুণঃপরিচালিত করা হয়। এবং এই অর্থের ব্যাপারে তাকে সচেতন করে তোলা অনেকটা তার স্নায়ু-বৈকল্য অতিক্রম করতে তাকে সামর্থ্য প্রদানে অবদান রাখতে পারে।

কেনো আমি আমার তত্ত্বের বা থিওরির নাম হিসেবে logotherapy বা লগোথেরাপি পারিভাষাটি প্রয়োগ করেছি তা আমি ব্যাখ্যা করছি। গ্রিক ভাষায় Logos মানে “অর্থ”। Logotherapy, বা The Third Viennese School of Psychotherapy’ র কয়েকজন লেখক এটিকে মানুষের সত্তা বা অস্তিত্বের ‘অর্থ’ এবং একজন মানুষের সে ‘অর্থ’কে অনুসন্ধানের দিকে নজর দেয়া” বলে আখ্যায়িত করে থাকে। লগোথেরাপি অনুযায়ী, একজন মানুষের জীবনে অর্থ অনুসন্ধানের এই প্রচেষ্টা হলো তার জন্য প্রাথমিক প্রেরণামূলক শক্তি। সেইজন্যে, আনন্দ তত্ত্বের (আমরা একে will to pleasure বা আনন্দের প্রতি  ইচ্ছাশক্তিও বলতে পারি) বিপরীতে ‘অর্থ’র প্রতি ইচ্ছাশক্তির কথা বলে থাকি যার উপর ফ্রয়ডিয় psychoanalysis বা মনঃসমীক্ষণ কেন্দ্রিভূত, এবং ভিয়েনার মনঃসমীক্ষণ এ্যাডলারের এ্যাডলারীয় মনস্তত্ত্ব ভিত্তিক will to power বা শক্তির প্রতি ইচ্ছাশক্তির বিপরীতে striving for superiority বা শ্রেষ্ঠত্বের সংগ্রাম শব্দটির দিকে নজর দেওয়া হয়েছে।

অর্থ’র প্রতি ইচ্ছাশক্তি (THE WILL TO MEANING)

একজন মানুষের অর্থ অনুসন্ধান তার জীবনের প্রাথমিক অনুপ্রেরণা এবং এটি কোনো সহজাত প্রেরণার “গৌণ যৌক্তিকতা” নয়। এই অর্থ অনুপম বা একক এবং তাতে নির্দিষ্ট যা কেবলই একজন মানুষের দ্বারা পরিপূর্ণ করা প্রয়োজন ও পরিপূর্ণ যেতে পারে। কেবল তখনই তা তাৎপর্য অর্জন করে যা তার নিজের অর্থের প্রতি ইচ্ছাশক্তিকে সন্তুষ্ট করে। অনেক লেখকের বিতর্ক মতে অর্থ আর মূল্যবোধ “defense mechanisms  বা প্রতিরক্ষা কৌশল, প্রতিক্রিয়া গঠন (reaction formation বা আপনি যা অনুভব করছেন তার বিপরীতে আচরণ করা) ও ঊর্ধ্বপাতন (sublimation বা “মন্দ তাড়না সমূহকে” ইতিবাচক এবং উৎপাদনশীল কার্যক্রমে পরিণত করা) ব্যতীত আর কিছু নয়”। কিন্তু আমার নিজের কথা বলতে গেলে, আমি কেবলমাত্র আমার defense mechanism বা “প্রতিরক্ষা কৌশল”র  নিমিত্তে বাঁচতে চাইবো না, কেবল “প্রতিক্রিয়া গঠন” এর নিমিত্তেও আমি মরতে প্রস্তুত নয়। যাইহোক, মানুষ তার আদর্শ আর মূল্যবোধের নিমিত্তে মরতেও সক্ষম!

কয়েক বছর আগে ফ্রান্সে একটি জনমত জরিপ চালানো হয়েছিল। ফলাফলে দেখা যায় যে ৮৯ শতাংশ মানুষ স্বীকার করে যে মানুষের বেঁচে থাকার জন্য নিমিত্তে “কিছু” প্রয়োজন। অধিকন্তু, ৬১ শতাংশ মানুষ স্বীকার করে যে তাদের জীবনে এমন কিছু বা এমন কেউ ছিল যার জন্য বা যাদের জন্য তারা এমনকি মরতেও প্রস্তুত ছিল। ভিয়েনার হাসপাতাল বিভাগে রোগী ও কর্মীদের মাঝে এই জরিপের পুনরাবৃত্তি করছিলাম, আর বাস্তবিকপক্ষে ফলাফল ফ্রান্সে হাজার হাজার মানুষের মানুষের মাঝে প্রদর্শিত ফলাফলের সাথে মিলে গিয়েছিল; ভিন্নতা ছিল মাত্র ২ শতাংশ।

আমেরিকার জন্স হপস্কিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ-বিজ্ঞানীদের দ্বারা আট-চল্লিশটি কলেজের ৭,৯৪৮ ছাত্রছাত্রীদের উপর আরেকটি পরিসংখ্যানগত জরিপ চালানো হয়েছিল। তাদের প্রাথমিক প্রতিবেদনটি ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ মেন্টাল হেলথ এর অর্থায়নে একটি দু’বছর মেয়াদী গবেষণার অংশ। তাদের বিবেচনায় “সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ” কি প্রশ্ন করা হলে, ১৬ শতাংশ ছাত্রছাত্রী “অনেক অর্থ উপার্জন করা” কে বেছে নেয়; ৭৮ শতাংশ  ছাত্রছাত্রী বলেছিল তাদের প্রথম লক্ষ্য হলো “আমার জীবনে কোনো উদ্দেশ্য এবং অর্থ খুঁজে পাওয়া”।

নিঃসন্দেহে, এমন কোনো ঘটনাও থাকতে পারে যেখানে মূল্যবোধের বিষয়ে কোনো ব্যক্তির উদ্বিগ্নতা আসলে অভ্যন্তরীণ গুপ্ত দ্বন্দ্বের ছন্দ-বেশ; কিন্তু যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে তা নিয়মের চেয়ে নিয়মের ব্যতিক্রমের প্রতিনিধিত্ব করে। এসব ঘটনায় আমাদেরকে প্রকৃতপক্ষে pseudo-value বা ভ্রান্ত-মূল্যবোধের মোকাবিলা করতে হবে, এবং সত্যিকার অর্থে তাদের মুখোশ খুলে দিতে হবে। কিন্তু একজন মানুষের মাঝে যা খাঁটি ও অকৃত্রিম – যেমন একজন মানুষের যতটা সম্ভব অর্থবহ জীবনের বাসনা – তার মুখোমুখির হওয়ার সাথে সাথেই একজন মানুষকে মুখোশ খুলে দেওয়া থামিয়ে দেওয়া উচিৎ। তখন যদি তা থামিয়ে দেওয়া না হয়, তাহলে একজন “unmasking psychologist” বা মুখোশ খুলে দেওয়ার মনোবিদ আসলে যে জিনিসটির মুখোশ খুলে দেয় তা হলো তার নিজের “গুপ্ত অভিপ্রায়” – যেমন, মানুষের মাঝে যা  কিছু অকৃত্রিম, যা কিছু অ-কৃত্রিমভাবে মানবিক তাকে অপভ্রষ্ট ও অবমূল্যায়ন করার জন্য তার চৈতন্যহীন প্রয়োজনীয়তা। 

অস্তিত্বের নিষ্ফলতা বা ব্যর্থতা  (EXISTENTIAL FRUSTRATION)

জীবনের অর্থ’র প্রতি মানুষের ইচ্ছাশক্তি হতাশও হতে পারে, যেখানে লগোথেরাপি অস্তিত্বের নিষ্ফলতা বা ব্যর্থতা সম্পর্কে কথা বলে। “existential” বা ‘অস্তিত্বগত’ শব্দটি তিনটি উপায়ে ব্যবহৃত হতে পারে: (১)স্বয়ং অস্তিত্বকে বোঝাতে, যেমন, বিশেষত মানব অস্তিত্বের অবস্থা; (২) অস্তিত্বের অর্থ বা তাৎপর্য; ও (৩) কারো অস্তিত্বে বা জীবনে মূর্ত অর্থ বা তাৎপর্য খুঁজ করার প্রচেষ্টা, তা বলতে গেলে অর্থ’র প্রতি ইচ্ছাশক্তি। অস্তিত্বের নিষ্ফলতা বা জীবনের ব্যর্থতা  স্নায়ুবৈকল্যে পরিণত হতে পারে। স্নায়ুবৈকল্য শব্দটি প্রচলিত অর্থ, যেমন psychogenic neurosis বা মস্তিষ্ক সৃষ্ট স্নায়ুবৈকল্য, এর বিপরীতে এধরনের স্নায়ুবৈকল্যের জন্য লগোথেরাপি একটি নতুন শব্দ উদ্ভাবন করেছে। যার নাম হলো “noögenic neuroses” । noögenic স্নায়ুবৈকল্যের উৎস psychological বা মনস্তাত্ত্বিক নয় বরং মানব অস্তিত্বের বা মানব জীবনের noölogical (গ্রিক শব্দ noös  মানে মন) ব্যাপ্তির মাঝে। (noology বা নওলজি হলো মন ও চিন্তা-ভাবনার সাথে সম্পৃক্ত শিক্ষার শাখা)। এটি আরেকটি লগোথেরাপিউটিক বা লগোথেরাপি চিকিৎসা বিষয়ক শব্দ যা বিশেষভাবে মানব ব্যাপ্তি সংক্রান্ত যেকোনো কিছুকে বোঝায়।

NOÖGENIC স্নায়ুবৈকল্য (NOÖGENIC NEUROSES)

প্রেরণা আর সহজাতের মধ্যে দ্বন্দ্ব থেকে NOÖGENIC স্নায়ুবৈকল্যের উত্থান হয় না, তবে অস্তিত্ত্বগত সমস্যা থেকে তার উত্থান হয়। এরকম সমস্যার মধ্যে জীবনরে অর্থ’র প্রতি ইচ্ছাশক্তির ব্যর্থতা এক বড় ভূমিকা পালন করে।

এটা স্পষ্ট যে নওজেনিক ঘটনায় যথাযথ ও পর্যাপ্ত থেরাপি বা চিকিৎসা সাধারণ অর্থে psychotherapy বা  মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা নয় কিন্তু লগোথেরাপি (অর্থ-চিকিৎসা); এটি এমন এক থেরাপি বা চিকিৎসা যা বিশেষভাবে মানব ব্যাপ্তিতে প্রবেশের সাহস করে।

আমি নিচের ঘটনাটি উল্লেখ করছি: একজন উচ্চ-পদস্থ আমেরিকান কূটনৈতিক ভিয়েনায় আমার অফিসে এসেছিলেন যাতে তিনি psychoanalytic বা মনঃসমীক্ষণমূলক চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারেন যা তিনি পাঁচ বছর পূর্বে নিউ ইয়র্কের একজন বিশ্লেষক দিয়ে শুরু করেছিলেন। শুরুতেই আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কেনো তিনি নিজেকে বিশ্লেষণ করার চিন্তা করেছেন, প্রথম দিকে তার বিশ্লেষণ কেনো শুরু করা হয়েছিল। বোঝা গেলো যে রোগী তার ক্যারিয়ার নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিলেন এবং আমেরিকান পররাষ্ট্র নীতি মেনে চলা ছিল তার পক্ষে সবচেয়ে কষ্টকর। যদিও তার বিশ্লেষক তাকে বার বার বলেছিলেন যে তার বাবার সাথে তার সম্পর্কের পুঃস্থাপনের চেষ্টা করা উচিৎ; কারণ তার কাছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার এবং তার ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরা তার পিতার “চিত্র ব্যতীত” আর কিছুই ছিল না। ফলশ্রুতিতে, তার চাকরীর সাথে তার অসন্তোষের কারণ ছিল তার বাবার প্রতি অবচেতনভাবে লালিত ঘৃণা। পাঁচ বছর ধরে চলতে থাকা এক বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে রোগীকে তার বিশ্লেষকের ব্যাখ্যাকে গ্রহণ করার জন্য বার বার অনুরোধ করা হয়েছিল যতক্ষণ না অবশেষে তিনি বাস্তবতাকে বুঝতে সমর্থ হয়েছিলেন। কয়েকটি সাক্ষাৎকারের পর পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল যে অর্থ’র প্রতি তার ইচ্ছাশক্তি তার পেশার দরুন ব্যর্থ হয়েছিল, এবং তিনি আসলে অন্য কোনো কাজের সাথে নিয়োজিত করার আকাঙ্খা করছিলেন। ভিন্ন চাকরী শুরু করার জন্য যেহেতু তার বর্তমান চাকরী ছেড়ে না দেওয়ার পেছনে কোনো কারণ ছিল না, তাই তিনি চাকরীটি ছেড়ে দিয়ে নতুন চাকরী শুরু করলেন, যা তিনি সবচেয়ে সন্তোষজনক ফলাফল নিয়েই তা করেছিলেন। তার এই নতুন পেশায় তিনি পাঁচ বছরেরও অধিক সময় সন্তুষ্ট থাকেন, যেমনটি তিনি সাম্প্রতিক বিবৃতিতে বলেছিলেন। এক্ষেত্রে আমি সন্দেহ করি যে, আমি কোনো না কোনোভাবে কোনো এক স্নায়ুবৈকল্য রোগীর অবস্থার সাথে বোঝাপড়া করছিলাম, আর সেইজন্য আমি ভেবে নিয়েছিলাম যে তার কোনো psychotherapy বা  মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা, বা এমনকি লগোথেরাপির প্রয়োজন নাই।

কারণ প্রকৃতপক্ষে তিনি কোনো রোগী ছিলেন না। সব সংঘাতই অবধারিতভাবে স্নায়ুবৈকল্য রোগ নয়; কিছুটা সংঘাত স্বাভাবিক ও স্বাস্থ্যকর। একই অর্থে যন্ত্রণাভোগ সব সময়ই একটি pathological phenomenon বা রোগগত ঘটনা নয়। বরং স্নায়ুবৈকল্যের কোনো উপসর্গের চেয়ে যন্ত্রণাভোগ হতে পারে মানুষের এক ভালো অর্জন, বিশেষকরে সে যন্ত্রণাভোগ যদি অস্তিত্বের ব্যর্থতা থেকে সৃষ্টি হয়। আমি কঠোরভাবে অস্বীকার করবো যে কারো অস্তিত্ব বা জীবনের অর্থ’র সন্ধান, বা এ সম্পর্কে তার সন্দেহ, সব ক্ষেত্রে যেকোনো অসুস্থতার ফলে বা অসুস্থতা থেকে নির্গত নয়। স্বয়ং অস্তিত্বের নিষ্ফলতা বা ব্যর্থতা প্যাথোলজিকল বা pathogenic বা রোগ সৃষ্টিতে সক্ষম নয়। একজন মানুষের জীবনের সার্থকতা সম্পর্কে উদ্বিগ্নতা, এমনকি তার হতাশাও একটি অস্তিত্ত্বগত বেদনা বা যন্ত্রণা কিন্তু কোনোভাবেই একটি মানসিক রোগ নয়। এটা এমন হতে পারে যে হতাশাকে উদ্বিগ্নতার নিরিখে ব্যাখ্যা একজন চিকিৎসক তার রোগীর অস্তিত্বের হতাশাকে প্রশান্তিদায়ক এক ঔষধের স্তূপের নিচ করব দিতে অনুপ্রাণিত করে। এটা বরং তারই কাজ যে তিনি রোগীকে তার বিকাশ ও উন্নয়নের অস্তিত্বের সংকটের মধ্যদিয়ে পথপ্রদর্শন করবেন।

লগোথেরাপি এর কাজকে কোনো রোগীকে তার জীবনের অর্থ সন্ধানের সহায়তা করা হিসেবে বিবেচনা করে। লগোথেরাপি যতটা না তাকে তার অস্তিত্বের বা জীবনের গুপ্ত logos বা অর্থ সম্পর্কে সচেতন করে তুলে, তারচেয়েও এটি একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রক্রিয়া। এই পরিসরে লগোথেরাপির সাথে মনঃসমীক্ষণের মিল রয়েছে। তবে, কোনো কিছু সম্পর্কে পুনরায় আত্মসচেতন করে তোলার জন্য লগোথেরাপি প্রচেষ্টার কর্মকাণ্ড কোনো ব্যক্তির মধ্যে অবচেতন সহজাত বাস্তবতার মধ্যে সীমিত থাকে না কিন্তু অস্তিত্বগত বাস্তবতার দিকেও মনোযোগ দেয়, যেমন তার অস্তিত্বের বা জীবনের সম্ভাব্য অর্থ এবং অর্থ’র প্রতি ইচ্ছাশক্তিকে সিদ্ধ করা। যাহোক, যে কোনো বিশ্লেষণ তার সত্তার গভীরে সে প্রকৃতপক্ষে কিসের আকাঙ্ক্ষা করে তার সম্পর্কে রোগীকে সচেতন করে তোলার চেষ্টা করে, এমনকি যখন তা থেরাপিউটিক বা চিকিৎসাগত প্রক্রিয়ায় (noölogical) নওলজিকল ব্যাপ্তিকে সংযুক্ত থেকে বিরত থাকে  তখনও। মনঃসমীক্ষণ বা মনঃ-বিশ্লেষণ থেকে লগোথেরাপির বিচ্যুতি ঘটে যতটা তা মানুষকে এক সত্ত্বা হিসেবে যার প্রধান উদ্বেগ বরং নিছক পরিতৃপ্তি ও প্রেরণা আর প্রবৃত্তির সন্তুষ্টি চেয়ে কোনো অর্থ পরিপূর্ণতায় নিহিত থাকে বলে বিবেচনা করে, বা  নিছকভাবে id (মনের যে অংশে নিজ সহজাত তাড়না ও প্রাথমিক প্রক্রিয়া সমূহ  প্রকাশ পায়), ego (অহংবোধ) ও superego বা অধ্যহং (বা মনের যে অংশ বিবেক ও নীতিবোধের আহ্বানে সাড়া দেয়) এর সাংঘর্ষিক দাবি সমূহের পুনঃস্থাপনের মধ্যে বলে বিবেচনা করে, বা বিবেচনা করা নিছক সমাজ আর পরিবেশের প্রতি অভিযোজন ও সমন্বয়সাধনে মধ্যে বলে। 

 নো ডাইনামিক্স (NOÖ-DYNAMICS)

নিশ্চয়ই, মানুষের অর্থ সন্ধান আভ্যন্তরীণ ভারসাম্যের চেয়ে অভ্যন্তরীণ স্নায়বিক চাপকে জাগ্রত করতে পারে। যদিও, এরকম অবিকল স্নায়বিক চাপ মানসিক স্বাস্থ্যের এক অপরিহার্য পূর্বশর্ত। আমি সাহস করে বলতে চাই যে কারো জীবনে যে অর্থ রয়েছে সে সম্পর্কে অবগত হওয়ার মতো পৃথিবীতে আর কোনো কিছুই নাই যা কোনো মানুষকে এমনকি সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতেও বেঁচে থাকার জন্য কার্যকরভাবে সাহায্য করতে পারে। এই সম্পর্কে ফ্রেড্রিক নিৎসের কথায় অনেক প্রজ্ঞা রয়েছে। তিনি বলেন, “যার ‘কেন’ বেঁচে থাকতে হবে তার কারণ রয়েছে সে প্রায় যে কোন ‘উপায় বা কিভাবে’কে সহ্য করতে সক্ষম”। এই বাক্যগুলিতে আমি একটি মন্ত্র দেখতে পায়, যাতে যেকোনো মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসার সত্যতা রয়েছে। নাৎসি বন্দী শিবিরে কেউ লক্ষ্য করে থাকবে যে, যে সব লোক বুঝতে পেরেছিল যে শেষ করার মতো কোনো কাজ তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল তারাই বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত ছিল। বন্দী শিবিরের উপর লিখা অন্যান্য পুস্তকের লেখকেরাও একই সিদ্ধান্তে পৌঁছান তখন থেকে। জাপান, উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ ভিয়েতনামের যুদ্ধ-বন্দীদের শিবিরে মনোচিকিৎসা বিষয় অনুসন্ধানও একই উপসংহারে পৌঁছাতে সক্ষম হয়।

আমার বেলায়, আমাদের যখন অশউইৎসের বন্দী শিবিরে নেওয়া হয়েছিল, প্রকাশের জন্য প্রস্তুত আমার এক পাণ্ডুলিপি আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল। নিঃসন্দেহে এই পাণ্ডুলিপিকে নতুন করে লিখার গভীর বাসনা আমাকে শিবিরে আমি যে কঠোরতার মধ্যে ছিলাম তা থেকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করেছিল। উদাহরণসরূপ, বাভারিয়া শিবিরে যখন আমি টাইফাস রোগে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম, তখন পাণ্ডুলিপিটি পুনরায় লিখতে নিজেকে সক্ষম করার উদ্দেশ্যে ছোট ছোট কাগজের টুকরায় আমি অসংখ্য মন্তব্য-মতামত সংক্ষেপে টুকে রেখেছিলাম, মুক্তির দিন পর্যন্ত আমাকে বাঁচতে হবে। আমি নিশ্চিত যে বাভারিয়ান এক বন্দী শিবিরের ছাউনির অন্ধকারে আমার হারিয়ে যাওয়া পাণ্ডুলিপির পুনর্গঠন আমাকে হৃদযন্ত্র-জনিত কারণে ভেঙ্গে পড়ার বিপদ অতিক্রম করায় সাহায্য করেছিল।

এভাবে, দেখা যায় যে মানসিক স্বাস্থ্য এক নির্দিষ্ট মাত্রার স্নায়ুবিক চাপের উপর নির্ভর করে, একজন মানুষ যা ইতিমধ্যে অর্জন করেছে এবং এখনও সম্পাদন করা উচিৎ তাদের মাঝে, অথবা একজন মানুষ এখন কে এবং তাকে কি হওয়া উচিৎ তার মধ্যে বিভেদের স্নায়ুবিক চাপ। এধরনে চাপ বা টেনশন মানুষের মধ্যে বিদ্যমান সহজাত আর সেজন্যে মানসিক কল্যাণের জন্য তা অপরিহার্য। মানুষকে তার সম্ভাব্য অর্থ পূর্ণ করার প্রক্রিয়ার মুখোমুখি করাতে আমাদের দ্বিধাগ্রস্ত হওয়া উচিৎ নয়। কেবল এভাবেই আমরা জীবনের অর্থ’র প্রতি তার ইচ্ছাশক্তিকে সুপ্তাবস্থা থেকে জাগিয়ে তুলতে পারি। প্রথমেই মানুষের যা প্রয়োজন তা হলো ভারসাম্য এরকম অনুমানকে আমি এক মানসিক স্বাস্থ্যবিধির মারাত্মক ভুল ধারণা হিসেবে বিবেচনা করি বা, জীববিজ্ঞানে যাকে বলা হয় homeostasis (হোমিওস্টেসিস বা ব্যুৎপত্তি ) যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেহের ভেতরের অবস্থাকে একই রাখার জন্য দেহ পরিবর্তনের প্রতি যে প্রতিক্রিয়া করে, যেমন, চাপহীন অবস্থা। মানুষের আসলে যা প্রয়োজন তা চাপহীন অবস্থা বা homeostasis নয় কিন্তু এক সার্থক লক্ষ্যের জন্য প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম করা, যা একটি মুক্তভাবে নির্বাচিত কর্ম। তার যা প্রয়োজন তা যেকোনো মূল্যে স্নায়ুবিক চাপ থেকে মুক্তি পাওয়া নয়, কিন্তু তার দ্বারা পূর্ণ হওয়ার অপেক্ষমাণ এক সম্ভাব্য অর্থ’র আহ্বান শোনা। মানুষের যা প্রয়োজন তা homeostasis নয় বরং তার যা প্রয়োজন তা হলো, যাকে আমি noödynamics বলি, যেমন, চাপের বিপরীতধর্মী ক্ষেত্রে অস্তিত্বগত বা অস্তিত্বের সক্রিয় শক্তি যেখানে এক মেরুকে পূর্ণ করার জন্য অর্থ দ্বারা প্রতিনিধিত্ব করা হয়েছে এবং অন্য মেরুকে প্রতিনিধিত্ব করা হয়েছে যে অর্থ’কে পূর্ণ করবে সে মানুষটি দ্বারা। আর কারো চিন্তা করা উচিৎ নয় যে এটি কেবল স্বাভাবিক পরিস্থিতির জন্য সত্য। স্নায়ুবৈকল্য ব্যক্তিদের মাঝে তা আরও বেশি সু-যুক্তিপূর্ণ। যদি স্থপতিরা কোনো জরাজীর্ণ তোরণকে শক্তিশালী করতে চাই, তাহলে তারা এর উপর স্থাপন করা বোঝা বৃদ্ধি করে, কারণ তাতে করে অংশ সমূহকে অধিকতর দৃঢ়ভাবে একত্রে সংযুক্ত করা হয়। তাই, থেরাপিস্টরা যদি তাদের রোগীদের মানসিক স্বাস্থ্যকে লালন করতে চাই, তাহলে তাদের কারো জীবনের অর্থ’র দিকে পুণঃঅভিমুখীকরণের মাধ্যমে এক নির্ভরযোগ্য পরিমাণের চাপ সৃষ্টি করাকে ভয় পাওয়া উচিৎ নয়।

অর্থ অভিমুখীকরণের উপকারী প্রভাব দেখিয়ে, আমি সেই অনুভূতির ক্ষতিকারক প্রভাব, যার সম্পর্কে আজ অনেক রোগী অভিযোগ করে, তার দিকে ফিরবো, যেমন তাদের জীবনের সর্বাত্মক ও চূড়ান্ত অর্থ-হীনতার অনুভূতি। তারা বেঁচে থাকার যোগ্য অর্থ সম্পর্কে সচেতনতা নয়। তাদের অভ্যন্তরীণ শূন্যতার অভিজ্ঞতা দ্বারা তারা ভূতগ্রস্ত, নিজেদের মধ্যকার এক শূন্যতা; তারা এমন এক পরিস্থিতি দ্বারা ধরাশায়ী যাকে আমি existential vacuum বা “অস্তিত্বগত শূন্যতা” আখ্যা দিয়েছি।            

Similar Posts