Last updated on January 24th, 2024 at 02:19 pm
অস্তিত্ত্বগত শুন্যতা (THE EXISTENTIAL VACUUM)
অস্তিত্বগত শূন্যতা বা অস্তিত্বের শূন্যতা বিংশ শতাব্দীর এক সুদূরপ্রসারী ঘটনা। বিষয়টি বোঝা যায়। একজন মানুষের মানুষ হয়ে উঠার পর থেকেই তাকে যে দ্বিগুণ ক্ষয়-ক্ষতির মধ্যদিয়ে যেতে হয় হয়তো তাই তার কারণ। মানব ইতিহাসের শুরুতেই মানুষ কিছু মৌলিক জৈবিক সহজাত-প্রবৃত্তি হারিয়ে ফেলে, যেখানে জৈবিক আচরণ বিদ্যমান এবং যার মাধ্যমে তা সুরক্ষিত থাকে। এরকম সুরক্ষা, স্বর্গের ন্যায়, সারাজীবন মানুষের কাছাকাছি রয়েছে। তার জন্য মানুষকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। যদিও, তার পাশাপাশি মানুষ তার সাম্প্রতিক বিকাশে আরও এক ক্ষতির সম্মুখীন হয় যতটা ক্ষতির সম্মুখীন হয় তার আচার-আচরণ গড়ে তোলা ঐতিহ্যের দ্রুত হ্রাস পাওয়ার কারণে। কোনো সহজাত-প্রবৃত্তি আর তাকে কি করতে হবে তা জানান দেয় না, আর কোনো ঐতিহ্যই তাকে বলে না তাকে কি করা উচিৎ; মাঝে মাঝে সে জানে না সে আসলে কি করতে চাই। তার চেয়ে বরং সে হয় অন্য লোকেরা যা করে তার অনুকরণ করতে চাই (conformism), নতুবা অন্য লোকেরা তাকে যা করাতে চাই তাই সে করে (totalitarianism)।
সম্প্রতি এক পরিসংখ্যান তদন্তে প্রকাশ করেছে যে আমার ইউরোপীয় ছাত্রছাত্রীদের মাঝে, ২৫ শতাংশ ছাত্রছাত্রী কম-বেশী এক চিহ্নিত মাত্রার অস্তিত্বগত শূন্যতা বা জীবনের অর্থ-হীনতা লক্ষ্য করা যায়। আমার আমেরিকান ছাত্রছাত্রীদের মাঝে তা ২৫ নয়, বরং ৬০ শতাংশ ছিল।
একঘেয়েমি পরিস্থিতিতেই অস্তিত্বগত শূন্যতা স্বয়ং পরিলক্ষিত হয়। এখন আমরা জার্মান দার্শনিক আর্থার শওপেনহাওয়ারকে বুঝতে পারি যখন তিনি বলেছিলেন যে মানবজাতি স্পষ্টতই চিরকাল মর্মপীড়া আর একঘেয়েমির দু’টি প্রান্তের মাঝে আন্দোলিত করার বা দোদুল্যমান থাকার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে। প্রকৃত সত্যে, মর্মপীড়ার চেয়ে একঘেয়েমি এখন সমাধানের আরও সমস্যার সৃষ্টি করছে, এবং নিঃসন্দেহে মনঃচিকিৎসকের দ্বারস্থ করছে। আর এ সমস্যা ক্রমবর্ধমানভাবে গুরুতর হয়ে উঠছে, কারণ ক্রমবর্ধমান যন্ত্রপাতি এবং তার ব্যবহার (automation) সম্ভবত সাধারণ শ্রমিকদের জন্য সহজলভ্য অবসর সময়ের প্রকাণ্ড বৃদ্ধির দিকে ধাবিত করবে। দুঃখের বিষয় হলো এদের অনেকেই তাদের সমস্ত নতুন করে পাওয়া অবসর সময় নিয়ে কি করতে হবে তা জানবে না।
উদাহরণ সরূপ আমরা বিবেচনা করতে পারি, Sunday neurosis বা “রবিবারের স্নায়ুবৈকল্য”, যখন সপ্তাহের ব্যস্ততার হিড়িক শেষ হয়ে যায় ও নিজেদের মাঝে শূন্যতা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে তখন যারা তাদের জীবনের সন্তুষ্টিহীনতা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে তাদের এ ধরনের হতাশা পীড়িত করে। অনেক আত্মহত্যার ঘটনার পেছনে রয়েছে অস্তিত্বগত শূন্যতা বা জীবনের অর্থ-হীনতা। বিষণ্ণতা, আগ্রাসন আর মাদকাসক্তির মতো বিস্তৃত ঘটনা বোধগম্য নয় যদি না আমরা তাদের পেছনে অস্তিত্বগত শূন্যতাকে অনুধাবন করতে পেরেছি। আর এটি কয়েদী এবং বয়োবৃদ্ধি লোকদের সংকটের বেলায়ও সত্যি।
অধিকন্তু, অস্তিত্বগত শূন্যতা প্রকাশের বিভিন্ন মুখোশ ও ছদ্মবেশ রয়েছে। মাঝে মধ্যে জীবনের অর্থ’র প্রতি হতাশ ইচ্ছাশক্তি (will to meaning) প্রাতিনিধিকভাবে ‘শক্তি’র প্রতি ইচ্ছাশক্তি (will to power) দ্বারা ক্ষতিপূরণ করা হয়, অর্থের (টাকা-পয়সা) প্রতি ইচ্ছাশক্তি (will to power) হলো সবচেয়ে আদিম প্রকৃতির ‘শক্তি’র প্রতি ইচ্ছাশক্তি। অন্যান্য ক্ষেত্রে, সুখের/আনন্দের প্রতি ইচ্ছাশক্তি অর্থ’র প্রতি হতাশ ইচ্ছাশক্তির স্থান দখল করে। সেইজন্যে, অস্তিত্বগত হতাশা প্রায়শই যৌন খেসারতে রূপ নেই। এরকম ঘটনায় আমরা লক্ষ্য করি যে অস্তিত্বগত শূন্যতায় যৌন কামেচ্ছা (sexual libido) অনিয়ন্ত্রিত হয়ে উঠে।
স্নায়ুবৈকল্যজনিত ঘটনায় এক অনুরূপ ঘটনা ঘটে। নির্দিষ্ট কিছু feedback mechanism ও দুষ্টচক্র (vicious-circle) বিন্যাস রয়েছে, যার সম্পর্কে আমি পরবর্তীতে আলোচনা করবো। যাহোক, কেউ বার বার লক্ষ্য করে থাকতে পারে যে, এই লক্ষণ-বিদ্যা (symptomatology) এক অস্তিত্বগত শূন্যতাকে আক্রমণ করেছে, যেখানে তারপর তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এধরনের রোগীদের মধ্যে যে জিনিসটির সাথে আমাদের মোকাবিলা করতে হবে তা কোনো নওজেনিক স্নায়ুবৈকল্য (noögenic neurosis) নয়। যাইহোক, রোগীকে তার অবস্থা অতিক্রম করাতে আমরা কখনও সফল হবো না, যদি না আমরা লগোথেরাপির সাথে সাইকোথেরাপিউটিক চিকিৎসার সংযোজন করে থাকি। কারণ অস্তিত্বগত শূন্যতা বা জীবনের শূন্যতাকে পূর্ণ করার মাধ্যমে, রোগীকে রোগের অধিকতর পুনরাক্রমণ পীড়া থেকে বিরত রাখা হয়। সেজন্যে, লগোথেরাপি কেবল নওজেনিক ঘটনা বা পরিস্থিতিতে নির্দেশিত করা হয় না, যেমনটি উপরে ইঙ্গিত করা হয়েছে, বরং psychogenic বা মস্তিষ্ক সৃষ্ট রোগের ক্ষেত্রেও নির্দেশিত। আর মাঝে মাঝে somatogenic (pseudo-ছদ্মবেশী স্নায়ুবৈকল্য) neuroses বা শরীরে উৎস, শরীরকে আক্রান্ত বা শরীরের মাধ্যমে কাজ করা স্নায়ুবৈকল্যের জন্যও নির্দেশিত। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে, এক সময় অস্ট্রিয়ান মনোবিজ্ঞানী মাগদা বি. আরনল্ড বলেছিলেন, “প্রতিটি থেরাপিকেই কোনো না কোনো উপায়ে, কতোটা সীমাবদ্ধ তা কোনো বিষয় নয়, হতে হবে লগোথেরাপি”।
তার জীবনের অর্থ কি জানতে চাওয়া এমন এক রোগীর জন্য আমরা কি করতে পারি এখন তা বিবেচনা করা যাক।
জীবনের অর্থ (THE MEANING OF LIFE)
সাধারণ অর্থে একজন ডাক্তার এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে কিনা সে সম্পর্কে আমার সন্দেহ রয়েছে। কারণ ভিন্ন মানুষের কাছে, ভ্ন্নি দিনে ও ভিন্ন মুহূর্তে জীবনের অর্থও ভিন্ন হয়ে থাকে। তাই, যে জিনিসটি আসল বিষয় তা কিন্তু সাধারণ অর্থে জীবনের অর্থ নয় বরং প্রদত্ত কোনো বিশেষ মুহূর্তে একজন মানুষের জীবনের নির্দিষ্ট অর্থ’ই আসল বিষয়। সাধারণ অর্থে প্রশ্নটি একজন দাবা বিজয়ীর কাছে ছুড়ে মারার সমতুল্য: “গুরু,আমাকে বলুন তো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ (দাবার) চাল কোনটি”? কোনো খেলায় নির্দিষ্ট এক অবস্থা এবং কারো প্রতিপক্ষের নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য (বা ব্যক্তিত্ব) ব্যতীত শ্রেষ্ঠ বা এমনকি ভাল চাল বলতে আসলে কিছুই নেই। মানব অস্তিত্ব বা মানব জীবনের বেলাও একই হয়ে থাকে। কারো উচিৎ না জীবনের বিমূর্ত অর্থ বা মানের (abstract meaning of life) সন্ধান করা। প্রত্যেকেরই জীবনে মূর্ত কাজ সম্পাদনের জন্য তার নিজের নির্দিষ্ট বৃত্তি (vocation) বা উদ্দেশ্য (mission) রয়েছে যা পূর্ণতার দাবি করে। সেখানে তাকে প্রতিস্থাপন করা যাবে না, যাবেন না জীবনকে পুনরাবৃত্ত করা। এভাবে, প্রত্যেকের কাজই অনুপম, অনুপম তার কাজের বাস্তবায়নের নির্দিষ্ট সুযোগও।
প্রতিটি পরিস্থিতি যেহেতু একজন মানুষের কাছ প্রতিবন্ধকতার প্রতিনিধিত্ব করে এবং সমাধানের জন্য কোনো সমস্যা উপস্থিত করে, জীবনের অর্থ সম্পর্কিত প্রশ্নটিকে প্রকৃতপক্ষে উল্টিয়ে করা যেতে পারে। অবশেষে, মানুষকে তার জীবনের অর্থ কি জিজ্ঞেস করা উচিৎ নয়, বরং তাকে অনুধাবন করতে হবে যে যেন প্রশ্নটা তাকেই করা হয়েছে। এক বাক্যে বলতে গেলে, প্রত্যেক মানুষই তার জীবন দ্বারা প্রশ্নবিদ্ধ। এবং কেবল তার নিজের জীবনের জন্য উত্তর দেওয়ার মাধ্যমে সে জীবনের সেই প্রশ্নের প্রতি সাড়া দিতে পারে; কেবল দায়বদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে জীবনের প্রতি সে সাড়া দিতে পারে। এভাবে, লগোথেরাপি দায়বদ্ধতার মাঝে মানব অস্তিত্বের (জীবনের) একান্ত সারমর্ম দেখতে পায়।
অস্তিত্বের (জীবনের) সারমর্ম (THE ESSENCE OF EXISTENCE)
দায়বদ্ধতার উপর এই জোর লগোথেরাপির স্পষ্ট আশু-কর্তব্যে প্রতিফলিত হয়েছে, যা হচ্ছে: “বেঁচে থাকুন যেন আপনি ইতিমধ্যেই দ্বিতীয় বারের মতো জীবন-যাপন করছেন এবং আপনি যেমন এখন ভুলভাবে আচরণ করতে যাচ্ছেন ঠিক একই আচরণ যেন আপনি প্রথমবার করেছিলেন”! আমার কাছে মনে হয় এমন কোনো কিছুই নাই যা একজন মানুষের দায়বদ্ধতা বোধকে এই প্রবাদবাক্যের চেয়ে বেশি উদ্দীপ্ত করবে, যা প্রথমত তাকে কল্পনা করতে আহ্বান জানায় যে বর্তমান আসলে অতীত এবং, দ্বিতীয়ত, যে অতীত এখনও পরিবর্তিত ও সংশোধিত হতে পারে। এরকম এক হিতোপদেশ তাকে জীবনের সসীমতা’র এবং সে তার জীবন ও নিজের মধ্য থেকে কি উৎপন্ন করে তার চূড়ান্ত অবস্থার মুখোমুখি করে।
লগোথেরাপি রোগীকে তার নিজের দায়বদ্ধতা সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে সচেতন করে তোলার চেষ্টা করে; তাই, কি জন্য, কিসের প্রতি, বা কার কাছে সে নিজেকে দায়বদ্ধ ভাবে তার উপায় তার কাছে রাখা উচিৎ। সেজন্যে একজন লগোথেরাপিষ্ট বা লগোথেরাপি চিকিৎসক সকল সাইকোথেরাপিস্টদের মাঝে তার রোগীর উপর ভালো-মন্দের রায় চাপিয়ে দিতে সবচেয়ে কম প্রলোভিত, কারণ সে কখনওই রোগীকে চিকিৎসকের কাছে বিচার করার দায় স্থানান্তরের অনুমতি দেয় না।
তাই সমাজের প্রতি বা তার নিজের বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থেকে সে তার জীবনের কাজকে ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন কিনা তা সিদ্ধান্ত নেওয়া রোগীর উপর নির্ভর করে। যাইহোক, এমন লোকও আছে যারা কেবল নিজেদের জীবনকে তাদের কাছে নিযুক্ত করা কোনো কাজের বিষয়ে ব্যাখ্যা করে না বরং তাদের কাছে কাজের বরাদ্দ দেওয়া কঠোর কর্মদাতা সম্পর্কেও জীবনকে ব্যাখ্যা করে।
লগোথেরাপি যেমন কোনো শিক্ষা না, তেমনি ধর্মপ্রচারও না। এটি যেমন যৌক্তিক বিচার থেকে অনেক দুরে, তেমনি নৈতিক উপদেশ দেওয়া থেকেও অনেক দূরে। রুপক অর্থে বলতে গেলে, একজন লগোথেরাপিষ্ট কর্তৃক লালন করা ভূমিকা একজন চিত্রশিল্পীর চেয়ে একজন চক্ষু-বিশেষজ্ঞের ভূমিকার মতো। একজন চিত্রশিল্পী সে পৃথিবীকে যেভাবে দেখে তার চিত্র আমাদের কাছে উপস্থাপন করার চেষ্টা করে; একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ আমাদেরকে পৃথিবীকে এর প্রকৃত রূপে দেখার সমর্থ করে তোলার চেষ্টা করে। লগোথেরাপিষ্টের ভূমিকা রোগীর দৃষ্টি-নির্ভর ক্ষেত্রকে বিস্তার ও সম্প্রসারণে নিহিত যাতে সম্ভাব্য অর্থ’র পূর্ণাঙ্গ বিস্তৃত পরিসর তার কাছে বোধগম্য ও দৃশ্যমান হয়ে উঠে।
মানুষ যে তার জীবনের সম্ভাব্য অর্থ’র জন্য দায়বদ্ধ ও তাকে অবশ্যই তা বাস্তবায়ন করতে হবে, এই ঘোষণা দেওয়ার মাধ্যমে জোর দিয়ে বলতে চাই যে জীবনের সত্যিকারের অর্থ’কে মানুষের মধ্যে বা তার নিজের মনের মধ্যে না খুঁজে পৃথিবীতেই তাকে তা আবিষ্কার করতে হয়, যেন তা এক (closed system) একটি বন্ধ প্রক্রিয়া। আমি এই গঠনমূলক বৈশিষ্ট্যকে “the self-transcendence of human existence” বা মানবজীবনের আত্ম-সীমাতিক্রমী অস্তিত্ব (বা জীবন) বলে থাকি। এটার মানে এই যে, মানুষ হওয়া মানে সবসময় কোনো কিছুর ইঙ্গিত করা এবং কোনো কিছুর প্রতি বা নিজের চেয়ে কারো অন্য প্রতি পরিচালিত হওয়া – হোক তা কোনো পূর্ণ করার এক অর্থ বা মুখোমুখি হওয়ার জন্য কোনো মানুষ। যত-বেশি একজন মানুষ নিজেকে ভুলে যায় – নিজেকে কোনো অর্থপূর্ণ সেবা কাজে উৎসর্গ করার মাধ্যমে বা অন্য ব্যক্তিকে ভালবেসে উৎসর্গের মাধ্যমে – ততবেশি সে মানুষ হয়ে উঠে ও ততবেশি সে নিজেকে বাস্তবায়ন (self-actualisation) করে। আত্ম-বাস্তবায়ন (self-actualisation) বিষয়টি খুব একটি সাধারণ কারণে কোনোভাবেই অর্জনীয় নয়, কারণ যত-বেশি একজন মানুষ তাকে পাওয়ার জন্য সংগ্রাম করবে, ততবেশি সে তাকে হারাবে। অন্য অর্থে, আত্ম-বাস্তবায়নকে কেবল self-transcendence বা আত্ম-সীমাতিক্রমীর পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হিসেবেই অর্জন করা সম্ভব।
এ পর্যন্ত আমরা দেখালাম যে জীবনের অর্থ সবসময় পরিবর্তন হয়, কিন্তু তা (জীবনের অর্থ) কখনই থেমে যায় না। লগোথেরাপি অনুসারে, জীবনের এই অর্থ তিনটি ভিন্ন উপায়ে আবিষ্কার করতে পারি: (১) কোনো কাজ সৃষ্টি বা কোনো কাজ করা মাধ্যমে; (২) কোনো কিছুর অভিজ্ঞতা লাভ বা কারো সাথে সাক্ষাত হওয়ার মাধ্যমে; ও (৩) অবশ্যম্ভাবী যন্ত্রণাভোগের প্রতি আমাদের মনোভাবের মাধ্যমে। প্রথমটি হলো কিছু অর্জন বা সফলতা লাভের উপায়, যা বেশ স্পষ্ট। কিন্তু দ্বিতীয় ও তৃতীয়টির আরও বিশদ বর্ণনার প্রয়োজন।
জীবনের অর্থ সন্ধানের দ্বিতীয় উপায় হলো কোনো কিছুর অভিজ্ঞতা লাভ করা- যেমন সদ্গুণ, সত্য ও সৌন্দর্য – প্রকৃতি ও সংস্কৃতির অভিজ্ঞতার মাধ্যমে, বা তার একান্ত অনন্যতায় অন্য মানুষ সম্পর্কে অভিজ্ঞতার লাভের মাধ্যমে – তাকে ভালোবাসার মাধ্যমে।
ভালোবাসার অর্থ (THE MEANING OF LOVE)
মানুষেকে তার ব্যক্তিত্বের গভীরতম অন্ত:সারে গিয়ে বোঝার জন্য ভালোবাসাই হলো একমাত্র উপায়। কোনো মানুষই অন্য একজন মানুষের একান্ত গুরুত্বপূর্ণ গুণাবলি সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে অবগত হতে পারবে না যদি না সে তাকে ভালোবাসে। তার ভালোবাসার মাধ্যমে সে ভালোবাসার মানুষটির মাঝে সম্ভাব্য বৈশিষ্ট্য এবং উপাদান দেখতে সমর্থ হয়; তার চেয়েও, সে তার মাঝে এখনও বাস্তবায়িত হয়নি ও বাস্তবায়ন করা উচিৎ এমন সম্ভাবনাকে দেখে। অধিকন্তু, তার ভালোবাসার দ্বারা, ভালোবাসা ব্যক্তিটি ভালোবাসার মানুষের এই সম্ভাবনাকে বাস্তবায়নে সম্ভবপর করে তোলো। সে কি হতে সক্ষম ও তার কি হওয়া উচিৎ সে সম্পর্কে তাকে অবগত করার মাধ্যমে এই সম্ভাবনা সত্যে পরিণত করে।
লগোথেরাপিতে, ভালোবাসাকে যৌন বাসনা ও তথাকথিত ঊর্ধ্বপাতন (sublimation) অর্থে সহজাত প্রবৃত্তির এক নিছক ঘটনা হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়নি। যৌনতার মতো ভালোবাসা একটি প্রাথমিক ঘটনা। স্বাভাবিকভাবে, যৌনতা হলো প্রেম বা ভালোবাসা প্রকাশের একটি প্রক্রিয়া। যৌনতাকে প্রতিপাদন বা যুক্তিযুক্ত করা হয়, এমনকি পবিত্রকরণ করা হয়, যেইমাত্র, কিন্তু যদি, তা ভালোবাসার মাধ্যম হয়। এভাবে, ভালোবাসা বা প্রেমকে যৌনতার নিছক এক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে বোঝানো হয়নি, বরং, যৌনতা হলো সেই চুড়ান্ত একত্ববোধ, যাকে ভালোবাসা বা প্রেম বলা হয় তার অভিজ্ঞতা প্রকাশের উপায়। জীবনে অর্থ খুজে পাওয়ার তৃতীয় উপায় হলো যন্ত্রণা ভোগ করা।
যন্ত্রণাভোগের অর্থ (THE MEANING OF SUFFERING)
আমাদের কখনো ভুলে যাওয়া উচিৎ নয় যে এমনকি আমরা যখন কোনো হতাশাপূর্ণ পরিস্থিতির মুখোমুখি হই তখনও আমরা জীবনের অর্থ খুজে পেতে পারি, যখন আমাদের নিয়তিকে পরিবর্তন যায় না। কারণ তখন যে জিনিসটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে তা হলো সর্বোৎকৃষ্ট উপায়ে অনন্যভাবে মানব সম্ভাবনার প্রতি সাক্ষ্য বহন করা, যা হলো ব্যক্তিগত সংকটকে এক বিজয়ে রূপান্তর করা, কারো দুর্দশাকে এক মানব সফলতায় পরিণত করা। আমরা যখন কোনো পরিস্থিতিকে আর পরিবর্তন করতে সমর্থ নই, তখন আমরা নিজেদের পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় – কেবল অস্ত্রোপচার-অসাধ্য ক্যান্সারের মতো এক দুরারোগ্য ব্যাধির কথা ভাবুন।
একটি সুস্পষ্ট উদাহরণ দেওয়া যাক: একসময় এক বয়স্ক সাধারণ চিকিৎসক তার গুরুতর বিষণ্ণতার জন্য আমার কাছে পরামর্শ নেন। যাকে তিনি সমস্ত কিছুর উর্ধে ভালবেসেছিলেন সেই স্ত্রী দুই বছরে আগে মৃত্যু বরণ করার কারণে তিনি বেদনা কাটিয়ে উটতে পারছিলেন না। এখন, তাকে আমি কিভাবে সাহায্য করতে পারি? তাকে আমার কি বলা উচিৎ? যাইহোক, তাকে কিছু বলা থেকে আমি নিজেকে বিরত রাখলা ববং তাকে আমি একটি প্রশ্নের মুখোমুখি করলাম আর জিজ্ঞেস করলাম, “ডাক্তার সাহেব, আপনিই যদি প্রথমে মারা যেতেন তাহলে কি হতো, এবং আপনাকে ছাড়া যদি আপনার স্ত্রীকে একা থাকতে হতো”? “উহ্”, তিনি বললেন, “তার জন্য তা অনেক ভয়াবহ হতো; তাকে কতইনা যন্ত্রণা পেতে হতো”! যাতে আমি উত্তর দিয়েছিলাম, “ডাক্তার সাহেব, দেখুন, তিনি মৃত্যু বরণ করার কারণে এ ধরনের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছেন, আর আপনিই তাকে এ ধরনের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়েছেন – নিশ্চয়। এখন তার মূল্য হিসেবে আপনাকে বেঁচে থাকতে হচ্ছে ও তার জন্য শোক করতে হচ্ছে”। তিনি কোনো কথা বললেন না কিন্তু আমার সাথে হাত মিলালেন এবং শান্তভাবে আমার অফিস থেকে চলে গেলেন। যে মুহুর্তে আমরা যন্ত্রনার কোনো অর্থ খুজে পায় তখন তা আর যন্ত্রনা থাকে না, হতে পারে কোনো ত্যাগ বা হারানোর অর্থ।
সত্যিকার অর্থে এটি কোনো থেরাপি বা চিকিৎসা ছিল না, যেহেতু, প্রথমত, তার হতাশা আসলে কোনো রোগ ছিলনা; দ্বিতীয়ত, আমি তার নিয়তিকে পরিবর্তন করতে পারতাম না। আমি তার স্ত্রীকে পুনরূজ্জীবিত করতে পারতাম না। কিন্তু সেই মুহুর্তে আমি তার অপরিবর্তনীয় নিয়তির প্রতি তার মনোভাব পরিবর্তন করতে সফল হয়, যেমনটা সে মুহুর্ত থেকে তিনি অন্তত তার যন্ত্রনাভোগে এক অর্থ দেখতে পেতে শুরু করেন। লগোথেরাপির এটি একটি নীতি হলো মানুষের প্রধান উদ্বিগ্নতা কিন্তু আনন্দ লাভ করা বা যন্ত্রনা এড়িয়ে যাওয়া নয়, বরং তার জীবনে অর্থ নির্ণয় করা। সেজন্যে, তার যন্ত্রণাভোগের মাঝে কোনো অর্থ রয়েছে বলে মানুষ সে যন্ত্রণা ভোগ করতেও প্রস্তুত।
বিষয়টিকে পুরোপুরিভাবে পরিষ্কার করে বলতে হলে আমি বলব যে, জীবনের অর্থ খুজে পেতে কোনেভাবেই যন্ত্রণাভোগের প্রয়োজন নেই। আমি কেবল জোর দিয়ে বলতে চাই যে এমনকি যন্ত্রণাভোগ সত্ত্বেও জীবনের অর্থ সম্ভব – অবশ্য যন্ত্রণাভোগ যদি অনিবার্য হয়ে থাকে। তবে, যদি তা অনিবার্য হয়ে থাকে, তাহলে এর কারণ অপসারণই হবে অর্থবহ কোনো কিছু করা, হোক তা মনস্তাত্ত্বিক, জৈবিক বা রাজনৈতিক। অকারণে যন্ত্রণাভোগ বীরত্বের চেয়ে বরং ধর্ষকামী।
জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের প্রফেসর এডিথ ওয়েইকপফ-জুয়েলসন তার মৃত্যুর আগে লগোথেরাপির উপর তার নিবন্ধে মত দিয়েছিলেন যে, “আমাদের সমসাময়ীক মানসিক স্বাস্থ্য দর্শন ধারণা জোর দেয় যে মানুষকে খুশি হওয়া উচিৎ, কারণ অশান্তি বা অখুশি হওয়া হলো সমম্বয়হীনতার (maladjustment) লক্ষণ। এরকম এক ভালো-মন্দ বিচারের প্রক্রিয়া (value system) সম্ভবত অখুশি হওয়া সম্পর্কে অশান্তির কারণই অনিবার্য অশান্তির বোঝা বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য দায়ী। অন্য আরেক গবেষনায় তিনি আশা ব্যক্ত করেন যে লগোথেরাপি, “যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান সংস্কৃতিতে নির্দিষ্ট অস্বাস্থ্যকর প্রবণতাকে ব্যর্থ করে দিতে পারে, যেখানে দুরারোগ্য রোগের ভুক্তভোগীকে তার যন্ত্রণাভোগ সম্পর্কে গর্বিত হওয়ার এবং একে মর্যাদা-হানিকরের বদলে মর্যাদাসম্পন্ন বিবেচনা করার খুব কমই সুযোগ দেওয়া হয়” যাতে “সে কেবল অখুশি নয়, বরং অখুশি হওয়ার কারণে লজ্জিত”।
এমন পরিস্থিতিও আছে যেখানে কেউ তার কাজ করার সুযোগ থেকে বা তার জীবন উপভোগ করা থেকে বঞ্চিত; কিন্তু যে জিনিসটি কখনওই উড়িয়ে দেওয়া যায় না তা হলো যন্ত্রনাভোগের অনিবার্যতা। সাহসীকতার সাথে যন্ত্রনাভোগের এই প্রতিবন্ধকতা বা চ্যালেঞ্জ গ্রহনের মাঝে শেষ মুহুর্ত অবধি জীবনের অর্থ বজায় থাকে, এবং আক্ষরিক অর্থে শেষ পর্যন্ত এই অর্থ বজায় থাকে। অন্য অর্থে, জীবনের অর্থ একটি নিঃশর্ত বিষয়, কারণ তা এমনকি অনিবার্য যন্ত্রনাভোগের সম্ভাব্য অর্থ’কে অন্তর্ভুক্ত করে।
বন্দী শিবিরে সম্ভবত সবচেয়ে গভীরতম যে অজ্ঞিতা আমার হয়েছিল তা স্মরণ করছি। শিবিরে বেঁচে থাকার অস্বাভাবিকতা প্রকি আটাশ জনে একজনের বেশি ছিল না, যা সহজেই সঠিক পরিসংখ্যান দ্বারা যাচাই করা যেতে পারে। তবুও, আমার বইয়ের যে পাণ্ডুলিপিটি অশউইৎস শিবিরে আমার প্রথম আগমনের পর আমার কোটের ভেতর লুকিয়ে রেখেছিলাম তা কখনো উদ্ধার করা সম্ভব হবে বলে মনে হয়নি। এভাবে, আমার মানসিক উদ্ভাবনকে হারানো সহ্য করতে এবং তার যন্ত্রনা কাটিয়ে উঠতে হয়েছিল। আর তারপর আমার কাছে মনে হয়েছিল যেন কোনো কিছু এবং কেউই আমার উপর টিকে থাকতে পারবে না; নয় কোনো আমার নিজের দৈহিক বা মানসিক সন্তান! তাই, আমি নিজেই এরকম পরিস্থিতিতে আমার জীবন চুড়ান্তভাবে অর্থশুন্য ছিল কিনা সে প্রশ্নের মুখোমুখি হয়।
Comments are closed.