Man’s Search for Meaning Bangla-ম্যান্স সার্চ ফর মিনিং জীবন বদলে দেওয়া Inspiring বইয়ের বাংলা অনুবাদ 2023
Last updated on January 24th, 2024 at 02:19 pm
আমি তখনও লক্ষ্য করিনি যে এই প্রশ্নের যে উত্তর যার সাথে আমি এত আসক্তির সাথে যুদ্ধ করছিলাম তা ইতিমধ্যেই আমার অপেক্ষায় ছিল, আর তারপর শীঘ্রই এই উত্তর আমাকে দেওয়া হবে। ঠিক একই জিনিসটি ঘটে যখন আমাকে আমার কাপড়-চোপর সমর্পন করতে হয়েছিল এবং তার বদলে এক বন্দী যাকে অশউইৎস ট্রেন ষ্টেশনে পৌঁছার পরপরই ইতিমেধ্য গ্যাস চেম্বারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল তার জরাজীর্ণ নেকড়া পেয়েছিলাম। আমার পাণ্ডুলিপির বহু পৃষ্ঠার পরিবর্তে নতুন পাওয়া কোটের পকেটে আমি ইব্রিয় ভাষার প্রার্থনা বইয়ের ইহুদিদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থনা ‘শেমা ইসরায়েল’ সম্বলিত একটি ছেড়া পৃষ্ঠা খুজে পাই। কেবল তা কাগজে লিখে রাখার চেয়ে আমার চিন্তা-ভাবনাতে বেঁচে থাকার এক চ্যালেঞ্জ ব্যতীত এরকম একটি “কাকতালীয়” ঘটনাকে আমার কিভাবে ব্যাখ্যা করা উচিৎ?
আমার মনে পড়ে, একটু পর আমার মনে হয়েছিল আমি যেন অদুর ভবিষ্যতে মারা যাবো। যদিও এই বিপজ্জনক অবস্থায় আমার অধিকাংশ সহ-কর্মিদের চেয়ে আমার উদ্বেগ ছিল ভিন্ন। তাদের প্রশ্ন ছিল, “আমরা কি শিবির থেকে জীবিত ফিরে যেতে পারবো? কারণ, যদি না পারা যায়, তাহলে তার সমস্ত যন্ত্রনাভোগের কোনো মানে হয় না”। যে প্রশ্নটি আমাকে পরিবেষ্টিত করে রেখেছিল তা ছিল, “এসব যন্ত্রনাভোগের, আমাদের চার পাশে এই মৃত্যুর কোনো অর্থ আছে কি? কারণ তার যদি কোনো অর্থই না থাকে, তাহলে শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে যে বেঁচে থাকায় কোনো অর্থ নেই; কারণ এমন এক জীবন যার অর্থ এরকম ঘটনার উপর নির্ভর করে – যেমন কেউ এ থেকে রেহায় পায় কিনা – শেষ পর্যন্ত মোটেও যাপনের উপযুক্ত হবে না ।
মেটা-ক্লিনিকল সমস্যা (META-CLINICAL PROBLEMS)
অনেক রোগী আজ স্নায়ুবৈকল্যের লক্ষনের চেয়ে মানবিক সমস্যা নিয়ে একজন মনঃচিকিৎসকের শরণাপন্ন হয় অধিক পরিমাণে। কিছু কিছু লোক যারা ইদানিং মনঃচিকিৎসকের শরণাপন্ন হচ্ছে তারা পূর্বে কোনো ধর্মীয় প্রচারক, প্রিষ্ট বা রেবাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। এখন তারা প্রায়শই কোনো ধর্মীয় যাজকের কাছে হস্তান্তরিত হতে অস্বীকৃতি জানায় আর বরং “আমার জীবনের অর্থ কি”? এমন সব প্রশ্ন নিয়ে একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়।
লগোড্রামা A LOGODRAMA
আমি নিচের উদাহরণটি উদ্বৃতি করতে চাই: এক সময়, এগার বছর বয়সে মারা হওয়া এক বালকের মায়ের এক আত্মহত্যা প্রচেষ্টার পর আমার হাসপাতাল বিভাবে ভর্তি করা হয়েছিল। ড. কার্ট ককৌরেক তাকে একটি থেরাপিউটিক দলে অংশ গ্রহনের আমন্ত্রন করেছিলেন, ঘটনাক্রমে আমি যে রুমে তিনি সাইকোড্রামা পরিচালনা করছিলেন সেখানে ডুকে পড়ি। মহিলাটি তার কাহিনী বলছিলেন। তার বাচ্চার মৃত্যুর পর সে তার আরেক বড় ছেলের সাথে একাকী হয়ে পড়েছে। শিশু বয়সে পক্ষাঘাতের প্রভাবে ভোগে বড় ছেলে পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল। অসহায় ছেলেটিকে হুইল চেয়ারে করে নাড়াচাড়া করতে হতো। তার মা, যাহোক, তার নিয়তির বিরুদ্ধে বিদ্রুহ করেছিলো। কিন্তু যখন তার বড়ছেলে সহ একসাথে আত্মহত্যার চেষ্টা করে, তখন পঙ্গু ছেলেটিই তাকে আত্মহত্যা থেকে প্রতিহত করেছিলে; ছেলেটি বেঁচে থাকা পছন্দ করেছিল! তার কাছে জীবন অর্থবহ রয়ে যায়। তাহলে কেনো একই জিনিসটি তার মায়ের জন্যও ছিল না? কিভাবে তার জীবন এখনও অর্থ লাভ করতে পারে? আর আমরা তাকে এর ব্যাপারে সচেতন হওয়ার জন্য কিভাবে সাহয্য করতে পারি?
তাৎক্ষণিক প্রস্তুতিতে, আমি আলোচনায় অংশগ্রহন করলাম, এবং দলের অন্য মহিলাকে প্রশ্ন করলাম। আমি তাকে তার বয়স জিজ্ঞেস করলে, তিনি উত্তর দিলেন, “ত্রিশ”। আমি বললাম, “না, আপনার বয়স ত্রিশ নয় বরং আর মৃত্যু শয্যায় আপনি মিথ্যে বলছেন। এখন আপনি আপনার জীবনের দিকে ফিরে তাকাচ্ছেন, যে জীবন ছিল সন্তানহীন কিন্তু অর্থনৈতিক ও সামাজিক মর্যাদায় ভর্তি”। আর তারপর আমি তাকে এই পরিস্থিতিতে তিনি কি অনুভব করতেন তা কল্পনা করতে আহ্বান করলাম। “সে সম্পর্কে আপনি কি ভাববেন? নিজেকে আপনি কি বলবেন? প্রকৃতপক্ষে তিনি কি বলেছিলেন সে পর্বের সময় ধারকৃত টেপ রেকর্ড থেকে আমি তার উদ্বৃতি করছি।“ উহ, আমি একজন কোটিপতিকে বিয়ে করেছিলাম, ধন-সম্পদে ভর্তি আমার এক সহজ জীবন ছিল, ও আমি প্রত্যানুশারে জীবন যাপন করেছিলোম! আমি মানুষের সাথে ফষ্টিনষ্টি করেছিলাম; আমি তাদের বিব্রত করতাম! কিন্তু, এখন আমার বয়স আশি; আমার নিজের কোনো সন্তান নেই। একজন বৃদ্ধা হিসেবে আমি যখন পেছনে তাকায়, আমি তার সকল কিছুর কোনো মানে দেখি না; আসলে, আমি বলব আমার জীবন ছিল এক ব্যর্থতা”!
আমি তখন পঙ্গু ছেলেটির মাকে নিজেকে একইভাবে তার পেছনের জীবনের দিকে তাকিয়ে কল্পনা করার আন্ত্রন জানালাম। আসুন টেপ রেকর্ডার চালু করার পর শুনি তার কি বলার ছিল: “আমি সন্তানের আকাঙ্খা করছিলাম আর আমার আকাঙ্খা মঞ্জুর করা হয়; এক ছেলে মারা যায়; অন্যটি, পঙ্গু ছেলেটিকে কোনো এক প্রতিষ্ঠানে পাঠিয়ে দেওয়া হতো আমি যদি তার যত্ন না নিতাম। যদিও সে পঙ্গু আর অসহায়, সর্বোপরি সে আমার ছেলে। আর তাই আমি তার জন্য এক পুর্ণাঙ্গ জীবনের সম্ভাবনা তৈরি করি; আমি আমার ছেলেকে এক উত্তম মানুষ হিসেবে তৈরি করি”। এই মুহুর্তে অশ্রুজলের এক বিস্ফোরণ দেখা দেয়, সে কাঁদতে থাকে: আমার বেলায়, আমি শান্তিপূর্ণভাবে আমার পেছনের জীবনের দিকে তাকাতে পারি; আমি বলতে পারি যে আমার জীবন অর্থপূর্ণ ছিল এবং আমি তা পূর্ণ করার চেষ্টা করেছি; আমি সর্বোচ্চটা করেছি – আমি আমার ছেলের উত্তমটাই করেছি। আমার জীবন ব্যর্থ ছিল না”! যেন তাকে তার মৃত্যুসয্যা থেকে দেখে মনে হলো, হঠাৎ যেন সে তার জীবনে অর্থ দেখতে পাচ্ছিল, তার সমস্ত যন্ত্রনাভোগে যে অর্থ সম্পৃক্ত। তদুপরি, একই প্রজ্ঞানে এটাও পরিষ্কার হয়ে উঠছিলো যে তার মৃত ছেলের সংক্ষিপ্ত আয়ুর জীবন আনন্দ আর ভালোবাসায় এত সমৃদ্ধ হতে পারে যে হতে পারে যে তা আশি বছর বেঁচে থাকা এক জীবনের চেয়ে বেশি অর্থ অন্তর্ভুক্ত করতে পারে।
কিছুক্ষন পর আমি অন্য প্রশ্নে অগ্রসর হলাম, এ সময় আমি নিজেকে পুরো দলে লিপ্ত করি। প্রশ্ন ছিল একটি, বানর যাকে পলিও রোগের সিরাম উন্নয়নে ব্যবহৃত হচ্ছিল, আর একারনে বার বার বিদ্ধ করা হয়েছিল, সে কখনও তার যন্ত্রনাভোগের অর্থ উপলব্ধি করতে সক্ষম কিনা। সর্বসম্মতিক্রমে, দলটি উত্তর দেয় যে বানরটি নিশ্চয় উপলব্ধি করবে না; এর সীমিত বুব্ধিমত্তার কারণে সে মানুষের জগতে প্রবেশ করতে পারবে না, কেবলমাত্র জগৎ সেখানে এর যন্ত্রনা বোধগম্য হয়। তারপর পরবর্তী প্রশ্ন নিয়ে এগিয়ে যায়: আর মানুষের কি অবস্থা? আপনারা কি নিশ্চিত যে মানব জগৎ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বিবর্তনে প্রান্তিক স্থান? এটা কি বোধগম্য নয় যে তারপরও অন্য একটি ব্যাপ্তি রয়েছে, মানব জগতের বাইরে এক জগৎ; যে জগতে মানব যন্ত্রনাভোগের চুড়ান্ত অর্থ সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর খুজে পায়?
চমৎকার অর্থ (THE SUPER-MEANING)
এই চুড়ান্ত অর্থ মানুষের সীমিত intellectual বা বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থকে অপরিহার্যভাবে অতিক্রম ও ছাড়িয়ে যায়; লগোথেরাপিতে, আমরা এই প্রসঙ্গে এক super-meaning বা চমৎকার অর্থ সম্পর্কে কথা বলি। মানুষের কাছ থেকে যা প্রত্যাশা করা হয় তা কিন্তু জীবনের অর্থহীনতাকে সহ্য করা নয়, যেমনটা অস্তিত্ববাদী দার্শনিকরা শিক্ষা দেয়, ববং যুক্তিসঙ্গত শর্তে জীবনের নিঃশর্ত অর্থপূর্ণতাকে অনুধাবনে তার অক্ষমতাকে সহ্য করা। লগোস যুক্তির চেয়ে গভীর।
একজন মনঃচিকিৎসক যে চমৎকার অর্থ সম্পর্কিত ধারণার বাইরে যায় সে আগে আর পরে শীঘ্রই তার রোগীর দ্বারা বিব্রত হবেন, ঠিক যেমনটি আমার ছয় বছরের কন্যার প্রশ্নে আমি হয়েছিলাম, “আমরা কেনো ভালো প্রভু সম্পর্কে কথা বলি”? যার উত্তরে আমি বলেছিলাম, “কয়েক সপ্তাহ আগে তুমি হাম রোগ ভুগছিলে, আর তারপর উত্তম প্রভু তোমাকে পুর্ণ রোগমুক্তি প্রেরণ করেন”। যাহোক, ছোট মেয়েটি সন্তুষ্ট হয়নি, তাই সে যুক্তি খণ্ডন করে বলে, ভালো, কিন্তু বাবা দয়াকরে ভুলে যাবেন না: প্রথমে কিন্তু তিনি আমার কাছে হাম পাঠিয়েছিলেন”।
যাহোক, একজন রোগী যখন ধর্মীয় বিশ্বোসে ভিত্তিকে শক্ত হয়ে দাঁড়ায়, তার ধর্মীয় বিশ্বাসের থেরাপিউটিক প্রভাবকে ব্যবহার করে তদনুযায়ী তার আধ্যাত্মিক সম্বলকে কাজে লাগানোর পেছনে কোনো আপত্তি থাকতে পারে না। তা করার জন্য, মনঃচিকিৎসক নিজেকে রোগীর জায়গায় অবস্থান করাতে পারে। ঠিক তাই আমি এক সময় করেছিলাম, উদহারণসরূপ, যখন পূর্ব ইউরোপ থেকে একজন রেবাই (ইহুদি ধর্মীয় শিক্ষক) আমার কাছে এসে তার কাহিনী বলেছিলেন। তিনি তার প্রথম স্ত্রীকে হায়েছিলেন এবং অশউইৎসের বন্দী শিবিরে হারিয়েছেন তাদের ছয় সন্তানকে যেখানে তাদের গ্যাস দিয়ে মারা হয়েছিল, আর এখন শেষ পর্যন্ত দেখা গেল যে তার স্ত্রী বন্ধা। আমি লক্ষ্য করলাম যে, প্রজননই জীবনের কেবলমাত্র অর্থ নয়, কারণ তখন জীবন এমনিতেই অর্থহীন হয়ে যাবে, এবং প্রকৃতিগতভাবে অর্থহীন এমন কিছুকে নিছক এর ধারাবাহিকতার মাধ্যমে অর্থপূর্ণ করা যায় না। অবশ্য, রেবাই একজন সনাতন ইহুদি হিসেবে তার নিজের কোনো ছেলেই যে তার মৃত্যুর পর তার জন্য কখনও কাদিশ[1] পড়ার জন্য বেঁচে নেই সে হতাশার আলোকে তার দুর্দশাকে মূল্যায়ন করেছিলেন।
কিন্তু আমি ছেড়ে দেওয়ার মানুষ নই। তাকে সাহায্য করার জন্য তিনি পুণরায় তার সন্তানদের সাথে স্বর্গে দেখা করার আশা করেন কিনা জানতে চেয়ে আমি শেষ প্রচেষ্টা করলাম। তবে, আমার প্রশ্নের কারণে সে কান্নায় ফেটে পড়েন, আর এখন তার হতাশার আসল কারণ বেরিয়ে আসে: তিনি বর্ণনা করলেন যে তার সন্তানেরা যেহেতু নিষ্পাপ শহীদ[2] হিসেবে মৃত্যু বরণ করে, তারা স্বর্গে সর্বোচ্চ স্থানের উপযুক্ত বিবেচিত হয়েছে, কিন্তু একজন বৃদ্ধ, পাপী মানুষ হিসেবে তিনি আশা করতে পারেন না যে তার জন্য একই স্থান ধার্য করা হবে। আমি ছেড়ে না দিয়ে প্রতিক্ষেপণ করলাম, এটা বোধগম্য নয়, রেবাই, ঠিক এটাই ছিল আপনার সন্তানদের চেয়ে বেশি আপনার বেঁচে থাকার অর্থ: যেন আপনি এই কয়েক বছরের যন্ত্রনার মাধ্যমে নিজেকে বিশুদ্ধ করতে পারেন, যাতে অবশেষে আপনিও, যদিও আপনার সন্তানদের মতো নিষ্পাপ নয়, স্বর্গে তাদের সাথে মিলনের উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারেন? দাউদের পরমগীতে[3] কি লেখা নাই যে ঈশ্বর তোমার সকল কিছু সংরক্ষণ করেন? তাই সম্ভবত আপনার কোনো যন্ত্রনাভোগই ব্যর্থতায় পরিণত না হয়”। বহু বছরে প্রথম বারের মতো নতুন দৃষ্টিকোণ যা আমি তার কাছে এক নতুন পৃথিবীকে খুলে ধরতে সমর্থ হয়েছিলাম যাতে তার মাধ্যমে তিনি তার যন্ত্রনা থেকে নিস্তার পান।
জীবনের ক্ষণস্থায়ীত্ব (LIFE’S TRANSITORINESS)
যে জিনিসগুলি মানব জীবন থেকে অর্থ ছিনিয়ে নিয়ে যায় বলে মনে হয় তার মধ্যে কেবল যন্ত্রনাভোগই নয় বরং মৃত্যুও অন্তর্ভুক্ত। আমি কখনও একথা বলে ক্যান্ত হবো না যে, জীবনের প্রকৃত ক্ষণস্থায়ী দিকগুলি হলো কেবল সম্ভাবনা সমূহ; কিন্তু যখনই সম্ভাবনা সমূহ বাস্তবায়িত হয়, তা সেই মুহুর্তেই বাস্তবতায় রুপান্তরিত হয়; তাদের সংরক্ষিত করা হয় ও অতীতের মাঝে সরবরাহ করা হয়, যেখানে তাদের উদ্ধার করা হয় এবং ক্ষণস্থায়ীত্ব থেকে সংরক্ষণ করা হয়। কারণ, অতীতের মাঝে, কোনো কিছুই উদ্ধার করা অসম্ভব উপায়ে হারিয়ে যায়নি বরং সবকিছুই চূড়ান্ত এবং অপরিবর্তনীয়ভাবে সংরক্ষিত রয়েছে।
এভাবে, আমাদের অস্তিত্ত্বের বা জীবনের ক্ষণস্থায়ীত্ব কোনো ভাবেই একে অর্থহীন করে না। কিন্তু তা আমাদের দায়বদ্ধতাকে স্থাপন করে; কারণ সবকিছু আমাদের অপরিহার্যভাবে ক্ষণস্থায়ী সম্ভাবনাকে অনুধাবন করার উপর নির্ভর করে।
মানুষ ক্রমাগতভাবে বিদ্যমান সম্ভাবনার পরিমান সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেয়; এসব সম্ভাবনার কোনটিকে অ-সত্তায় দোষারোপ এবং কোনটি বাস্তবায়িত করা হবে? কোন সিদ্ধান্তকে একবার ও চিরজীবনের জন্য এক বাস্তবতায় রুপান্তর করা হবে, এক চিরস্থায়ী সময়ের বালিতে পদচিহ্ন” হিসেবে? যে কোনো মুহুর্তে, মানুষকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, হোক ভালো বা মন্দ, তার জীবনের স্মৃতিচিহ্ন কি হবে।
সাধারণত, মানুষ কেবল ক্ষনস্থায়িত্বের নাড়া ক্ষেত্রকে বিবেচনা করে এবং অতীতের পুর্ণ শস্যভাণ্ডারকে তাচ্ছিল্য করে, যেখানে সে শেষবারের মতো তার কর্ম রক্ষা করেছিল, তার আনন্দ আর যন্ত্রনাভোগও। কোনো কিছুকেই পূর্বাবস্থায় ফেরানো যাবে না, এবং কোনো কিছুকে বাতিল করা যাবে না। আমি বলব অতীত বা গত হওয়া হচ্ছে সবচেয়ে নিশ্চিত অস্তিত্ব বা সত্তা।
মানব অস্তিত্ত্বের অত্যাবশ্যকীয় ক্ষণস্থায়ীত্ব মনে ধারণ করে বলে, লগোথেরাপি নৈরাশ্যপূর্ণ নয় বরং সক্রিয়তাপূর্ণ। রূপকভাবে বিষয়টি প্রকাশ করতে আমরা বলতে পারি: pessimist বা নৈরাশ্যবাদী মানুষ হলো এমন এক ব্যক্তি যে ভয় আর দুঃখের সাথে পর্যবেক্ষণ করে যে তার দেয়াল পঞ্জিকা, যেখান থেকে সে প্রতিদিন একটি করে পাতা ছেঁড়ে, প্রতিটি অতিক্রান্ত দিনে তা পাতলা হয়ে উঠছে। অন্য দিকে, যে ব্যক্তি সক্রিয়ভাবে তার জীবনের সমস্যাকে আক্রমন করে সে হলো এমন এক ব্যক্তির মতো যে তার পঞ্জিকা থেকে ধারাবাহিকভাবে পাতা অপসারণ করবে এবং প্রথমে এর পেঁছনে সংক্ষেপে কয়েকটি ডায়রি মন্তব্য টুকে রাখার পর তা পরিষ্কারভাবে ও সতর্কতার সাথে এর পুর্বর্তীদের সাথে লিপিবদ্ধ করে। সে গর্ব আর আনন্দের সাথে এই মন্তব্যগুলিতে লিখে রাখা সকল চমৎকারিত্বের সাথে, যে সম্পূর্ণ জীবন সে ইতিমধ্যে পুর্নতার সাথে যাপন করেছে তাতে প্রতিফলন করতে পারে। যদি সে বুঝতে পারে যে সে বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছে তাহলে তা কিসের কাজে আসবে? যুবক লোকদের দেখে তার হিংসা করা বা তার নিজের হারিয়ে যাওয়া যৌবনের উপর স্মৃতিবিধুরতা বৃদ্ধি পাওয়ার পেছনে তার কোনো যুক্তি আছে? একজন যুবককে হিংসা করার তা কি যুক্তি আছে? একজন যুবক ব্যক্তির সম্ভাবনা থাকার কারনে, তার ভাগ্যে কি ভবিষ্যৎ রয়েছে? “না, ধন্যবাদ আপনাকে”, সে চিন্তার করবে। কারণ “সম্ভাবনার চেয়ে, আমার অতীতে রয়েছে বাস্তবতা, কেবল সম্পন্ন কর্মের ও লালিত প্রেমের বাস্তবতা নয়, বরং সাহসের সাথে ভোগ করা যন্ত্রনাভোগের। এই যন্ত্রনা সমূহ এমনকি যার বিষয়ে আমি সবচেয়ে বেশি গর্বিত, যদিও এসব জিনিস হিংসার উদ্রেগ করে না।
কৌশল হিসেবে লগোথেরাপি (LOGOTHERAPY AS A TECHNIQUE)
মৃত্যু ভয়ের মতো বাস্তববাদী ভয়কে এর সাইকোডাইনামিক[4] ব্যাখ্যা দিয়ে প্রশান্ত করা যাবে না; অন্য ভাবে, কোনো স্নায়ুবৈকল্য ঘটিত ভয়কে, যেমন খোলা জায়গার ভয় (agoraphobia), দর্শনগত বোধগম্যতার মাধ্যমে নিরাময় সম্ভব না। তবে,এরকম ঘটনা মোকাবিলায়ও লগোথেরাপি এক বিশেষ পদ্ধতির বিকাশ করেছে। যখনই এ পদ্ধতি ব্যবহৃত হয় তখন কি হচ্ছে তা অনুধাবনের জন্য, প্রারম্ভিক প্রস্তাব হিসেবে এক পরিস্থতিকে গ্রহন করি যা প্রায়শই স্নায়ুবৈকল্য ব্যক্তিদের মাঝে লক্ষ্য করা যায়, যেমন, (anticipatory anxiety) পূর্বাভাসজনি উদ্বেগ বা আশংকা। এই ভয়ের বৈশিষ্ট্য হলো যে, এটি ঠিক সেই ভয়কে উৎপন্ন করে যার সম্পর্কে রোগী সন্ত্রস্ত থাকে। উদহারণসরূপ, একজন ব্যক্তি যখন বৃহাদাকার কক্ষে প্রবেশের পর এবং অনেক লোকজনের মুখোমুখি হলে লজ্জা পাওয়ার ভয় করে, তকে তার প্রকৃতপক্ষে এরকম পরিস্থিতিতে আরও বেশি লজ্জা পাওয়ার প্রবণতা থাকে। এই প্রসঙ্গে কেউ হয়তো “আমরা সম্ভবত তাই বিশ্বাস করি যা সত্যি হোক বলে আমরা কামনা করি” কে “আমরা যাই ভয় করি তাই আমাদের ঘটে থাতে” তে রুপান্তর করতে পারি।
যতেষ্ট হাস্যকরভাবে, একইভাবে একজন মানুষ যা ভীত থাকে তাই ভয় তার জন্য নিয়ে আসে, যেমনিভাবে কোনো জবরদস্তি করা অভিপ্রায় যা একজন মানুষ জবরদস্তিভাবে প্রত্যাশা করে অসম্ভব করে তোলে। অতিরিক্ত অভিপ্রায় বা ইচ্ছা অথবা “hyper-intention” তাকে আমি যেভাবে বলে থাকি, আমরা বিশেষভাবে যৌন স্নায়বৈকল্যজনিত ঘটনায় লক্ষ্য করে থাকি। একজন মানুষ যতবেশি তার যৌন শক্তিকে প্রদর্শন করার চেষ্টা করে বা্ একজন মহিলা যতবেশি তা যৌন উত্তেজনা (orgasm) লাভের সামর্থকে প্রদর্শন করার চেষ্টা করে, তত কম তারা তাতে সফল হয়। আনন্দ হলো এক পার্শপ্রতিক্রিয়া বা উপজাত, তাকে অবশ্যই পার্শপ্রতিক্রিয়া বা উপজাত হিসেবে রাখা চাই, আর যে পরিমানে আনন্দকে স্বয়ং লক্ষ্য হিসেবে পরিণত করা হয় ততটা তাকে ধ্বংশ ও নষ্ট করা হয়।
উপরোল্লেখিত অতিরিক্ত অভিপ্রায় বা ইচ্ছার পাশাপাশি, অতিরিক্ত মনোযোগ, বা hyper-reflection বা অত্যাধিক প্রতিফলন, লগোথেরাপিতে এত যেভাবে নামকরণ করা হয়েছে, pathogenic বা রোগ সৃষ্টির কারণও হতে পারে ( যা অসুস্থতার দিকে পরিচালিত করে)। পরবর্তী ক্লিনিকল প্রতিবেদন আমি যা বলতে চাই তা নির্দেশ করবে: যৌনতাকে উপভোগ করতে না পারার অভিযোগ নিয়ে এক যুবতী আমার কাছে এসেছিল। ঘটনার ইতিহাসে দেখা যায় যে বাল্য বয়সে তাকে তার পিতার দ্বারা যৌন নির্যাতিত হয়েছিল। যদিও তা এত দুঃখজনক অভিজ্ঞতা ছিল না যা তার যৌন স্নায়ুবৈকল্যে পরিণত হয়, যেমনটি সহজেই অনুমেয়। কারণ দেখা যায় যে, জনপ্রিয় মনঃবিশ্লেষণধর্মী সাহিত্য পড়ার মাধ্যমে রোগী ক্রমাগতভাবে ভয়ানক সম্ভাবনায় জীবন-যাপন করেছে যে একদিন তার দুঃখজনক অভিজ্ঞতা মাসুল নেবে। এই পূর্বাভাসজনি উদ্বেগ বা আশংকা তার মেয়েলিপনাকে দৃঢ় করতে অতিরিক্ত অভিপ্রায় বা ইচ্ছা এবং তার সঙ্গীর পরিবর্তে তা নিজের উপর আবর্তিত অতিরিক্ত মনোযোগ উভয়ের জন্ম দেয়। এটি রোগীকে যৌন আনন্দের সবোচ্চ অভিজ্ঞতা লাভে অক্ষম করে তোলার জন্য যতেষ্ট, যেহেতু যৌন উত্তেজনাকে অপ্রতিফলিত ত্যাগ আর সঙ্গীর প্রতি অত্মসমর্পনের এক অনিচ্ছাকৃত প্রভাব হিসেবে রাখার পরিবর্তে এক অভিপ্রায় বা ইচ্ছার ও মনোযোগের বস্তুতে রুপান্তর করা হয়েছিল। সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য লগোথেরাপির মধ্যদিয়ে যাওয়ার পর, তার যৌন উত্তেজনা অভিজ্ঞতা লাভে রোগীর অতিরিক্ত মনোযোগ ও অভিপ্রায়ের সামর্থকে বিপ্রতিফলিত বা de-reflected[5] করা হয়েছিল, আরও একটি লগোথেরাপিউটিক মেয়াদ পরিচয় করিয়ে দিতে। যখন তার মনোযোগকে যথাযথ বস্তুর দিকে, যেমন তার সঙ্গি, পুনঃস্থিরকৃত বা refocused করা হয়, তখন তার যৌন উত্তেজনা স্বঃতস্পূর্তভাবে আপনিতেই প্রতিষ্টিত হয়ে যায়।[6]
একজন মানুষ যাকে ভয় পায় সে ভয়ের কারণে যা সংঘটিত হয়ে থাকে এবং অধ্যধিক অভিপ্রায় একজন মানুষ যা করতে চাই তাকে অসম্ভব করে তোলে তার দ্বিগুনা সত্যের উপর লগোথেরাপির paradoxical intention বা বৈপরিত অভিপ্রায় পদ্ধতি ভিত্তি করে। ১৯৩৯ সালের দিকে জার্মান ভাষায় আমি বৈপরিত অভিপ্রায়ের বর্ণনা করি।[7] এ পদক্ষেপে ভয়ার্ত বা ফোবিক রোগীকে একদম যে জিনিসকে সে ভয় করে তা করতে মনস্থ করার আমন্ত্রন করা হয়, হোক তা এক মুহুর্তের জন্য।
[1] মৃতদের জন্য প্রার্থনা।
[2] ইল’কিদ্দুশ বাসবেম, যেমন, ঈশ্বরের নাম পবিত্রকরণের জন্য।
[3] “তুমি আমার ভ্রমণ গণনা করিতেছ; আমার নেত্রজল তোমার কুপাতে রাখ; তাহা কি তোমার পুস্তকে লিখিত নাই”? (পরমগীত ৫৬: ৮ পদ)
[4] বিস্তৃত অর্থে Psychodynamics হলো মনস্তত্ত্বের পন্থা যা মানব আচরণের অধিনে যেমন অনুভূতি, আবেগ এবং তা প্রারম্ভিক অভিজ্ঞতার সাথে কিভাবে সম্পৃক্ত হয় তা মনস্তাত্ত্বিক শক্তির পদ্ধতিগত শিক্ষাকে জোর দেয়। এটি বিশেষভাবে সচেতন প্রেরনা আর অচেতন প্রেরনার মধ্যে গতিশীল সম্পর্কে আগ্রহী।
[5] অত্যধিক প্রতিফলকে রোগীদের মনোযোগকে নিজেদের মধ্য থেকে এবং নিজেদের কাজ থেকে ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে বাধাগ্রস্ত করতে লগোথেরাপির এক পরিকল্পিত পদ্ধতি।
[6] অত্যধিক মনোযোগ ও অত্যধিক প্রতিফলন থিওরি’র উপর ভিত্তি করে যৌন অক্ষমতার ঘটনা চিকিৎসা করতে এক বিশেষ লগোথেরাপিউটিক পদ্ধতির উন্নতি করা হয়েছে, উপরে যেমন বর্ণনা করা হয়েছে (ভিক্টর ই. ফ্রাঙ্কল, The Pleasure Principle and Sexual Neurosis বা আনন্দ তত্ত্ব ও যৌন স্নায়ুবৈকল্য The International Journal of Sexology, Vol. 5, No. 3 [1952], pp. 128-30). যদিও তা নিয়ে লগোথেরাপি তত্ত্ব সম্পর্কে এই সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনায় তার বিবরণ অসম্ভব।
[7] Viktor E. Frankl, “Zur medikamentosen Unterstützung der Psychotherapie bei Neurosen,” Schweizer Archiv für Neurologie und Psychiatrie, Vol. 43, pp. 26-31.