Man’s Search for Meaning Bangla-ম্যান্স সার্চ ফর মিনিং জীবন বদলে দেওয়া Inspiring বইয়ের বাংলা অনুবাদ 2023
Last updated on January 24th, 2024 at 02:19 pm
বন্দী শিবিরে আমার অভিজ্ঞতা
এই বইটি শিবিরে ঘটে যাওয়া সমস্ত প্রকৃত ঘটনার বর্ণনা বলে দাবি করে না। তবে এটি একটি লাখ লাখ মানুষ বার বার যে অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছিল তার একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বর্ণনা। এটি একটি হাজার হাজার বন্দীদের মধ্য থেকে বেঁচে থাকা একজন মানুষের শিবিরের অভ্যন্তরীণ কাহিনী। আর এই কাহিনীটি শিবিরে ঘটে যাওয়া মহা ভয়াবহতা সম্পর্কেও নয়, যার সম্পর্কে অনেক কিছু লিখা হলেও খুব কমই মানুষ আমলে নিয়েছে। তাই এই কাহিনীটি আসলে শিবিরে ঘটে যাওয়া অনেক ছোট ছোট ঘটনার বিবরণ। অন্য অর্থে, একটি বন্দী শিবিরের দৈন্দিন জীবন-যাপন সাধারণ বন্ধীদের মনে কিভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল সে প্রশ্নে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবে।
এখানে বর্ণিত অনেক ঘটনা বড় বড় ও বিখ্যাত শিবিরে ঘটেনি। তবে ছোট ছোট শিবিরগুলিতেই সবচেয়ে বেশি ইহুদি নিধনের ঘটনা ঘটেছিল। এটি কোনো মহান বীর বা শহীদদের যন্ত্রণা ও মৃত্যুর কাহিনী নয়, নয় কোনো বিশিষ্ট ক্যাপুদের বর্ণনা। ক্যাপুরাও ছিল আমাদের মতো কয়েদি। কিন্তু তারা জার্মান কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা নিয়ে তাদের বিশ্বস্ত লোক হিসেবে কাজ করতো। কয়েদি হিসেবে তারা ছিলো সুপরিচিত। তাই বইটি কক্ষতাশালী মানুষের দুর্ভোগের সাথে তেমন সম্পৃক্ত নয়। তবে বইটি দুর্ভোগ আর নিঃসংতার বলি হওয়া অপরিচিত ও তালিকাহীন বহুসংখ্যক মানুষের ত্যাগ, নির্যাতন আর মৃত্যুর সাথে সম্পৃক্ত। এই অপরিচিত ও তালিকাহীন সাধারণ বন্দীরা জামার হাতায় আলাদা কোনো চিহ্ন বহন করেনি। আর যাদের ক্যাপুরা সত্যিকার অর্থে অনেক ঘৃণা করতো। এই সাধারণ বন্দীদের যখন খাবারের স্বল্পতা দেখা দিত বা কিছুই থাকতো না, তখন ক্যাপুদের ক্ষুধার্ত হয়নি। সত্যি বলতে অনেক ক্যাপুদের অবস্থা এমন ভালো ছিল যে, যা তাদের সারাজীবনে কখনও ছিল না। অনেক সময় সাধাণ বন্দীদের প্রতি তারা SS বা (চুটচাফল) জার্মান কর্তৃপক্ষের কারারক্ষীদের চেয়েও নিষ্ঠুর ছিল। SS বাহিনীর লোকদের চেয়ে নিষ্ঠুরভাবে তারা বন্দীদের মার-ধর করতো। এসব ক্যাপুদের বন্দীদের মাঝ থেকে থেকে এইরকম পরিস্থিতিতে উপযোগী ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন লোকদের বেছে নেয়া হতো। আর ক্যাপুরা যদি জার্মান কর্তৃপক্ষের প্রত্যাশানুযায়ী তাদের বাধ্য না থাকতো, তাহলে সাথে সাথে তাদের পদবীর অবনতি ঘটতো। তাই তারা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই অনেকটা SS’র লোক ও শিবির পরিচালকদের মতো হয়ে উঠতো। আর তদেরও একই মনস্তাত্ত্বিক বা মানসিক উপাদানে বিচার করা হতো।
একজন বাইরের কারো পক্ষে শিবির-জীবন সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণ করা সহজ। তার ধারণা হতে পারে অনুভূতি আর করুণা মিশানো। কারণ বন্দীদের মাঝে বিদ্যমান বেঁচে থাকার কঠোর সংগ্রাম সম্পর্কে তার ধারণা নেই। আর তাদের কাছে দৈনন্দিন জীবনে এই নিরলস সংগ্রাম ছিল প্রতিদিনের খাবারের জন্য। নিজের জীবনের জন্য, নিজের স্বার্থে বা একজন ভাল বন্ধুর সার্থে সংগ্রাম।
*****
বন্দীদের বহন করে নিয়ে যায় এমন একটি গাড়ির কথা ধরা যাক। গাড়িটির নির্দিষ্ট কিছু বন্দীকে এক শিবির থেকে অন্য শিবিরে বহন করে নিয়ে যাওয়ার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়ছিল। তবে মোটামুটিভাবে গাড়িটি কোথায় যাবে তা অনুমান করতে পেরেছিলাম। হয়তো বন্দীদের নিয়ে গাড়িটি কোনো এক গ্যাস চেম্বারে যাবে তাদের পুড়িয়ে মারার জন্য। কাজ করতে পারে না এমন অসুস্থ বা দুর্বল কয়েদিদের বাছাই করে গ্যাস চেম্বার আর শব-চুল্লি রয়েছে এমন একটি বড় শিবিরে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। এই বাছাই করার সময় কয়েদিরা একে অন্যে বিরুদ্ধে বা দলে দলে বিচ্ছিন্নভাবে মারামারি করতো। মারামারি করার পেছেনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল যেন সেই বাছাই করা মানুষের তালিকা থেকে তার নিজের নাম ও তার বন্ধুর নামটি বাদ পড়ে যায়। তবুও সবাই জানতো যে তালিকা থেকে কাউকে বাদ দিতে হলে তার জায়গায় অন্য কাউকে খুজে বের করতে হবে।
প্রতিটি গাড়িতে করে এক নির্দিষ্ট সংখ্যক বন্দীকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কোন গাড়িটি তাদের নিয়ে যাবে সেটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিলনা কারণ বন্দীদের সবাইকে কোনো একটি সংখ্যা ব্যতীত কোনো কিছুই মনে করা হতো না। শিবিরে প্রবেশের সময় (অন্তত অশউইৎয শিবিরে তাই করা হতো) নথিপত্র সহ তার কাছে থাকা সবকিছু বন্দীদের কেড়ে নিয়ে ফেলা হলো। সেইজন্যে প্রক্যেকেরই কোনো না কোনো কাল্পনিক নাম বা পেশা দাবি করার সুযোগ ছিল। আর বিভিন্ন অযুহাতে অনেকেই সত্যিকারের নাম বা পেশা লুকিয়ে কাল্পনি নাম বা পেশার কথা বলেছিল। শিবির কর্তৃপক্ষ শুধু বন্দীদের নাম্বার বা সংখ্যায় আগ্রহী ছিল। প্রায়শই: তাদের এই নাম্বারটি তাদের চামড়ায় উল্কি করে ও ট্রাউজার, জ্যাকেট বা কোটের নির্দিষ্ট কোন স্থানে সেলাই করে দেওয়া হতো। কোনো কারা রক্ষী কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে চাইলে সে শুধুই কয়েদির গায়ের বা কাপড়ে সেলাই করা নাম্বারটি দিকে তাকাতো। সে কখনও তার নাম জিজ্ঞেস করতো না। আর আমরা কতোই না সে তাকিয়ে থাকাকে ভয় পেতাম!
রওনা হওয়ার পথে পরিবহন বহরে ফিরে আসি। বহরের সে গাড়ির ভেতরে নীতি-নৈতিকতা নিয়ে ভাবার সময় বা ইচ্ছা কোনটাই সেখানে ছিল না। সবাই শুধু তার জন্য বাড়িতে অপেক্ষায় থাকা পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবদের জন্য নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার চিন্তায় মগ্ন। তাই কোনও সংকোচ ছাড়াই একে অন্যের জন্য গাড়িতে জায়গার ব্যবস্থা করে দিতো।
আমি যেমন আগেই বলেছি যে ক্যাপো বাছায়ের প্রক্রিয়াটি ছিল একটি নেগেটিভ বা নেতিবাচক প্রক্রিয়া। সবচেয়ে নির্দয়-নিষ্ঠুর বন্দীদের মাঝ থেকে একাজের জন্য তাদের বেছে নেওয়া হতো। যদিও তাতে কিছু কিছু স্বস্তিকর ব্যতিক্রমও ছিল। কিন্তু SS সদস্যদের দ্বারা পরিচালিত যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া ছাড়াও বন্দীদের মাঝে একধরনের আত্ম-নির্বাচনী পদ্ধতিও চালু ছিল সেখানে। বছরের পর বছর এক শিবির থেকে অন্য শিবিরে ঘুরে ঘুরে জীবন সংগ্রামে যারা সব ধরনের সংকোচ-বোধ হারিয়ে ফেলেছিল, কেবলমাত্র সেসস্ত বন্দীরাই নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। ন্যায় বা অন্যায় উপায়ে এমনকি জোর খাটিয়ে, চুরি আর বন্ধুদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে হলেও তারা নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে প্রস্তুত ছিল। আমরা যারা অনেক ভাগ্যবান, সম্ভাবনা বা অলৌকিক সাহায্যের কারণে সেখান থেকে ফিরে আসতে পেরেছিলাম, আমরা জানি যে আমাদের উত্তমটি ফিরে আসেনি।
বন্দী শিবির সম্পর্কে অনেক বাস্তব বিবরণের দলিল ইতিমধ্যে লেখা হয়েছে। এখানে তা যদি তা কারও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার অংশ হয়ে থাকে তাহলে তা গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হবে। আর এই অভিজ্ঞতার প্রকৃত বৈশিষ্ট্য নিয়ে আমি পরবর্তীতে আলোচনা করবো। আমরা যারা এক সাথে শিবিরে বন্দী ছিলাম, তা তাদের বর্তমান প্রেক্ষাপটের আলোকে তাকে বোধগম্য করে তোলার চেষ্টা করবে। আর আলোচনাটি যারা কখনও কোনো শিবিরে যায়নি তাদের যে অল্প সংখ্যক মানুষ বেচে গিয়েছিল তাদের সম্পর্কে জানতে সাহায্য করবে। বুঝতে সাহায্য করবে শিবির থেকে মুক্ত হওয়ার পর তাদের জীবন-যাপন কতো কঠিন হয়ে উঠেছে। সাবেক এই বন্দীরা প্রায়শই বলে থাকে যে, “শিবিরের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে কথা বলতে আমাদের ভালো লাগে না। কারণ যারা শিবিরে জীবন-যাপন করেছে তাদের কাছে সে অভিজ্ঞতার কোনো ব্যাখ্যা প্রয়োজন হয় না। আর, তখন আমাদের কি পরিস্থিতি ছিল এবং আমরা এখন কি পরিস্থিতি আছি তা কেউ বুঝতে পারবেন না”।
বিষয়টি নিষ্ঠার সাথে উপস্থাপন করা খুবই কঠিন, যেহেতু তার জন্য মনোবিজ্ঞানের মতে নির্দিষ্ট এক বৈজ্ঞানিক detachment বা নিরাসক্তি’র প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু, কয়েদী হয়েও কি একজন মানুষ তার প্রয়োজনীয় detachment বা আবেগ-কেন্দ্রিক পরিস্থিতি মোকাবিলার কৌশল বা নিরাসক্তি অর্জন করতে পারে? একজন বহিরাগত মানুষ নিরাসক্তি মেনে নিতে পারে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই নিরাসক্তি’কে মূল্যায়ন করার যোগ্যতা তার নাই। শিবিরে বন্দী থাকা মানুষটির তার যথাযথ মূল্যায়ন করতে সমর্থ। তার বিচার বস্তুনিষ্ঠ নাও হতে পারে; তার মূল্যায়ন হতে পারে অসঙ্গতিপূর্ণ। এটি একটি অবশ্যম্ভাবী বিষয়। এক্ষেত্রে তার জন্য আমাদের অবশ্যই নিরপেক্ষ হওয়া উচিৎ আর এধরনের বইয়ে এটাই প্রকৃত সমস্যা। মাঝে মাঝে আমাদের খুব অন্তরঙ্গ কিছু অভিজ্ঞতা সম্পর্কে কথা বলার সাহস থাকা দরকার। আমি শুধু আমার কয়েদী নাম্বারটি ব্যবহার করে বেনামে এই বই লিখতে মনস্থির করেছিলাম। কিন্তু পাণ্ডুলিপি সমাপ্ত হওয়ার পর আমি লক্ষ্য করে দেখলাম যে বেনামে প্রকাশের ফলে বইটি এর অর্ধেক মূল্য হারাবে। তাই ভাবলাম যে, আমার বিশ্বাস সম্পর্কে খোলাখুলি-ভাবে কথা বলার জন্য আমার সৎসাহস সঞ্চার প্রয়োজন। সেইজন্যে, আমার ভালো না লাগা সত্ত্বেও মানুষের কাছে শিবির জীবনের আমার ব্যক্তিগত মুহূর্তগুলি তুলে ধরতে রাজি হলাম।
এই বইয়ের বিষয়বস্তু থেকে প্রয়োজনীয় ধারনা লালন করার কাজ আমি পাঠকের কাছে ন্যস্ত করছি। বইয়ের বিষয়বস্তু সমূহ হয়তো কয়েদীদের বন্দী জীবনের মানসিক অবস্থা সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার বেলায় অবদান রাখতে পারে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে কয়েদিদের মানসিক অবস্থা নিয়ে অনুসন্ধান করা হয়েছিল। তাতে আমাদের মাঝে “barbed wire sickness” বা “কাঁটাতার ব্যাধি” নামক একধরনের মানসিক রোগের লক্ষণ পাওয়া গিয়েছিল। ফরাসি মনোবিজ্ঞানী গিস্টাব ল্যাবুঁর বিখ্যাত উক্তি উদ্ধৃত দিয়ে আমি বলতে পারি যে, “psychopathology of the masses”, বা ‘গণ-মানুষের মনোরোগবিদ্যা’ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করার জন্য আমরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাছে ঋণী। কারণ যুদ্ধের কারণে সৃষ্টি হয় স্নায়ু যুদ্ধ, আর তাতে সৃষ্টি হয় বন্দী শিবির”।
এই কাহিনীটি সাধারণ এক বন্দী হিসেবে শিবিরে আমার অভিজ্ঞতার কথা বলে। তারপরও উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো যে শেষের কয়েক সপ্তাহ ব্যতীত, আমি নিজে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হওয়া সত্ত্বেও শিবিরে আমি একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বা এমনকি মনঃচিকিৎসক হিসেবে নিয়োগ পায়নি। ভাগ্যক্রমে আমার সহকর্মীদের কেউ কেউ নষ্ট কাগজের টুকরো থেকে তৈরি ব্যান্ডেজ প্রয়োগ করার প্রাথমিক-চিকিৎসা পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন। কিন্তু আমার নাম্বার ছিল ১১৯,১০৪, আর অধিকাংশ সময় আমি খনন কাজ এবং রেল লাইন বসানোর কাজ করতাম। এক সময় আমার কাজ ছিল জলের নল বসানোর জন্য সড়কের নিচে একা একা সুড়ঙ্গ খনন করার। এই কাজে আমার দক্ষতার জন্য ১৯৪৪ সালের বড়দিনের ঠিক আগে আমাকে পুরস্কৃত করা হয়েছিল। পুরস্কার হিসেবে আমাকে একটি তথাকথিত ‘প্রিমিয়াম কুপন’ দেওয়া হয়েছিল। যে নির্মাণ সংস্থার কাছে আমাদের সত্যিকার অর্থে দাস হিসেবে বিক্রি করা হয়েছিল, সে সংস্থাটি কুপনগুলি প্রকাশ করেছিল। সংস্থাটি শিবির কর্তৃপক্ষকে প্রত্যেক কয়েদীর জন্য প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট মূল্য পরিশোধ করেছিল। প্রতিটি কুপনের জন্য সংস্থাটিকে পনের ফেনিগ বা পয়সা খরচ করতে হয়েছিল। একটি কুপন দিয়ে ছয়টি সিগারেট বিনিময় করা যেতো, যদিও কয়েক সপ্তাহ পর অনেক সময় তাদের মেয়াদ শেষ হয়ে যেতো। আমি বারোটি সিগারেট পরিমাণ মূল্যের একটি টোকেনের গর্বিত মালিক হয়ে গিয়েছিলাম পুরস্কারটি পাওয়ার পর। তবে তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি তা হলো, বারোটি সিগারেটের বিনিময়ে বারোটি সুপ ক্রয় করা যেতো, আর অনাহারে থাকা মানুষদের জন্য বারোটি সুপ অনাহার থেকে মুক্তির উপায়।
সিগারেট খাওয়ার সুযোগটি আসলে ক্যাপোদের জন্যই সংরক্ষিত ছিল। তাদের জন্য নিশ্চিত সাপ্তাহিক কুপনের বরাদ্দ থাকতো। গুদাম বা কোনো কর্মশিবিরের দলনেতা হিসাবে কাজে নিয়োজিত কয়েদিরাও বিপজ্জনক কাজ করার বিনিময়ে কয়েকটি সিগারেট পেতো। তারপর যারা বেঁচে থাকার সব ইচ্ছা হারিয়ে জীবনের শেষ দিনগুলি “উপভোগ” করতে চেয়েছিল তাদের জন্য সিগারেট খাওয়া ছিল একমাত্র ব্যতিক্রম। সুতরাং, আমরা যখন কোন সহকর্মীকে তার নিজের সিগারেট ফুকতে দেখতাম, তখন আমরা বুঝে নিতাম যে ধৈর্য ধারণ করার জন্য শক্তির প্রতি সে বিশ্বাস হারিয়ে-ফেলেছে। আর নিজের শক্তির প্রতি সে বিশ্বাস একবার চলে গেলে বেঁচে থাকার ইচ্ছা ফিরে আসে খুব কম।
অনেক কয়েদির মানসিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে এবং তাদের অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত একত্রিত করা বিশালাকারের তথ্যভাণ্ডার গবেষণা করলে শিবির জীবনের প্রতি কয়েদিদের মানসিক প্রতিক্রিয়ার তিনটি স্তর লক্ষ্য করা যায়: (ক) শিবিরে তার আগমনের পরের সময়, (খ) একজন কয়েদীর শিবির জীবনের সাথে ভালভাবে খাইখাইয়ে নেওয়ার সময় (গ) এবং শিবির থেকে তার মুক্তি ও মুক্তির পরের সময়।
কয়েদীদের shock বা প্রচণ্ড মানসিক ধাক্কা হলো প্রথম স্তরের একটি লক্ষণ। অনেক সময় এই মানসিক shock কয়েদীদের শিবিরে আগমনের আগে থেকেই থাকতো। উদাহরণ হিসেবে শিবিরে প্রবেশের সময় আমার নিজের অবস্থার কথা বলতে পারি।
একটি ট্রেন পনের শ কয়েদি নিয়ে কয়েক দিন কয়েক রাত ধরে ভ্রমণ করছিল। প্রতিটি বগিতে আশিজন করে মানুষ ছিল। সবাইকে তাদের অবশিষ্ট মাল-পত্রের লাগেজ ব্যাগের উপর শুয়ে পড়তে হয়েছিল। বগিসমূহ এতই ভর্তি ছিল যে শুধুমাত্র জানালার উপরের অংশ দিয়ে-ই ভোরের ধূসর আলো ভেতরে আসছিল। সবাই ধারণা করেছিল ট্রেনটি হয়তো কোনো যুদ্ধোপকরণ তৈরির কারখানার দিকে যাচ্ছে, যেখানে আমাদের জোর করে শ্রমে নিয়োগ করা হবে। আমরা বুঝতে পারিনি যে, সাইলেসিয়া না গিয়ে আমরা ইতিমধ্যেই পোল্যান্ড চলে এসেছি। ইঞ্জিনের হুইসলের ভূতুড়ে শব্দ শুনে মনে হচ্ছিল যেন তা অশুভ বোঝা নিয়ে ধ্বংসযজ্ঞের দিকে ধাবিত হওয়ার কারণে সমবেদনার সাথে সাহায্যের জন্য চিৎকার করছে। প্রধান এক স্টেশনের কাছে আসতেই ট্রেনটি লাইন পরিবর্তন করলো। হঠাৎ উদ্বিগ্ন যাত্রীদের সারিতে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু হলো, “সংকেত দেখা যাচ্ছে, ঐ-তো অশউইৎয শিবির!” সে মুহূর্তে সবার হৃদয়ের কম্পন এক মুহূর্তের জন্য থেমে যায়। অশউইৎয শিবির ছিল সকলপ্রকার ভয়াবহতার এক নাম, যেখানে ছিল গ্যাস চেম্বার,শব-চুল্লি, ও হত্যাকাণ্ড। ধীরে ধীরে, অনেকটা ইতস্ততভাবে এগিয়ে চলছে ট্রেনটি, মনে হচ্ছিল যেন ট্রেনটি যাত্রীদের অশউইৎয এর ভয়ানক অনুমান থেকে যতদূর সম্ভব দুরে রাখতে চাচ্ছে।
আসন্ন ভোরের সাথে সাথে শিবিরের বিশাল আকৃতি পরিষ্কার হয়ে উঠে। দীর্ঘ প্রন্তরজুড়া সারি সারি কাঁটাতারের বেড়া; নিরাপত্তা দুর্গ; সার্চলাইট; জরা-জীর্ণ মানুষের দীর্ঘ সারি, সবকিছুই। ধুসর ভোরের ধূসরতা সোজা নির্জন সড়কে বেয়ে বয়ে গেছে, কি জানি কোন গন্তব্যের পানে। কিছু বিচ্ছিন্ন চিৎকার আর বাঁশির আদেশ ছিল। তাদের কোনও অর্থই আমরা বুঝিনি তখন। আমার কল্পনায় আমি দেখতে পেলাম ফাঁসির মঞ্চ সমূহ, যেখানে ঝুলছে মানুষ। আমি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়লামভ। ভয় পাওয়াটা ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার, তবে ক্রমে ক্রমে, পদে পদে আমাদের শিবিরের ভীবৎস ও সীমাহীন ভয়াবহতার সাথে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে হবে।
আমরা ষ্টেশনের ভেতরে ঢুকলাম। কারারক্ষিদের হুঙ্কার করা আদেশের কারণে প্রাথমিক নীরবতার বিগ্ন ঘটে। তখন থেকে, পুরো শিবির-জুড়ে বার বার আমাদের সেই রুক্ষ, কঠোর কণ্ঠস্বর শুনতে হয়েছিল। তাদের শব্দ ছিল অনেকটা কোন মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ভুক্তভোগীর শেষ চিৎকারের মতো। তবে তাতে একধরনের ভিন্নতাও বিদ্যমান। তাদের সেই চিৎকার ছিল মানুষকে উত্ত্যক্ত করার উগ্রতা মাখানো। শুনে মনে হতো তা যেন বার বার খুনের স্বীকার হওয়া একজন মানুষের মুখ থেকে বের হওয়া চিৎকার। ট্রেনটি থামতেই কোচের দরজাগুলি সজোরে খুলে দেওয়া হলো আর একদল কয়েদি সৈনিক ঝড়ের বেগে ভেতরে ডুকে পড়লো। তাদের গায়ে ছিল ডোরাকাটা উর্দি, মাথা ছিল কামানো, কিন্তু তারা দেখতে ছিল বেশ হৃষ্টপুষ্ট। তারা সবাই কিছুটা রসিকতার ছলে সম্ভাব্য সব ইউরোপীয় ভাষায় কথা বলছিল যা সে মুহূর্তে উদ্ভট শোনাচ্ছিল। তুচ্ছ কোনো বস্তুকে আঁকড়ে ধরা ডুবন্ত কোনো মানুষের মতো আমার সহজাত আশাবাদ এমন এক বেপরোয়া পরিস্থিতিতেও একটি ভাবনায় আটকে গেলো। ভাবলাম এই কয়েদিরা তো দেখতে মোটামুটি ভাল, তাদের দেখলে মনে হয় তারা খুব হাসি-খুশির মধ্যে আছে। কে জানে বাবা? আমারও হয়তো তাদের আনন্দদায়ক পরিস্থিতিকে ভাগ করে নেওয়ার কোনো ব্যবস্থা হবে।
মনোচিকিৎসায় “delusion of reprieve” বা স্বস্তি বিভ্রম নামে একটি মানসিক অবস্থা রয়েছে। কোনো অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি তার মৃত্যুদণ্ডের আগ মুহূর্তে ভেবে বিভ্রান্ত হয় যে, মৃত্যুদণ্ডের একেবারে শেষ মুহূর্তে হয়তো তার দণ্ডাদেশ স্থগিত করা হতে পারে। আমরাও টুকরো টুকরো আশাকে আঁকড়ে ধরেছিলাম আর বিশ্বাস করেছিলাম যে শেষ পর্যন্ত হয়তো অশউইৎয শিবির তেমনটা মন্দ হবেনা। সেইসব কয়েদিদের লাল গাল আর গোলাকার চেহারা সমূহ আমাদের কাছে এক উদ্দীপনার কারণ হয়ে উঠে। আমরা তখনও জানতাম না যে তারা ছিল বিশেষভাবে নির্বাচিত কয়েদিদের নিয়ে গঠিত একটি বিশেষ সৈন্য দল। তারা বছরের পর বছর দিনের পর দিন স্টেশনগুলিতে নতুন গাড়ি করে বহন করে নিয়ে আসা বন্দীদের গ্রহণকারী দল হিসেবে কাজ করছিলো। দলটি নতুন আগন্তুকদের এবং, দুষ্প্রাপ্য সামগ্রী আর কয়েদিদের দ্বারা গোপনে পাচার করে নিয়ে আসা গহনাগাঁটি সহ তাদের লাগেজের দায়িত্ব গ্রহণ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ বছরগুলিতে সম্ভবত ইউরোপের এই অঞ্চলটার অশউইৎয ছিল এক অদ্ভুত জায়গা। সেখানে স্বর্ণ ও রোপা, প্লাটিনাম আর হীরার বিরাট খনি থাকতে পারে এখানে। শুধু বিশাল এই খনিতে নয়, বরং SS এর দখলেও থাকতে পারে অনেক মূল্যবান পাথর।
সম্ভবত দুই’শ মানুষ ধারণের জন্য নির্মিত একটি ছাউনিতে ঠাসাঠাসি করে পনের শ বন্দীকে জমায়েত করা হলো। আমরা ছিলাম শীতার্ত আর ক্ষুধার্ত, আর শুয়ে থাকা তো দূরের কথা উবু হয়ে বসে থাকার জন্যও সেখানে পর্যাপ্ত জায়গা ছিল না। চার দিনের মধ্যে পাঁচ আউন্স পরিমাণের একটুকরো রুটিই ছিল আমাদের একমাত্র খাবার। ছাউনিটির দায়িত্বে থাকা পুরনো কয়েদিদের সাথে অভ্যর্থনাকারী দলের এক সদস্যের সাথে প্লাটিনাম আর হীরার তৈরি একটি টাই-পিনকে কেন্দ্র করে দর কষাকষি করতে শুনতে পেলাম। কেনা-বেচার বেশিরভাগ লাভই অবশেষে ( schnapps) শ্ন্যাপ্স নামের এক ধরনের মদ কিনতে চলে যাবে। একটি ‘আনন্দঘন সন্ধ্যা’র জন্য প্রয়োজনীয় মানসম্পন্ন শ্ন্যাপ্স ক্রয় করতে কত হাজার জার্মান মুদ্রার প্রয়োজন হয়েছিল তা আমি আর মনে করতে পারছিনা। তবে আমি জানি যে বহুদিনের পুরনো কয়েদিদের শ্ন্যাপ্স মদের প্রয়োজন হতো। এরকম পরিস্থিতিতে মদের মাধ্যমে নিজেদের একটু উদ্দীপ্ত তোলার জন্য তাদের কে দোষারোপ করবে? সেখানে আবার এমনও একদল কয়েদি ছিল যাদের SS কর্তৃপক্ষ সীমাহীন পরিমাণে নেশাজাতীয় পানীয় সরবরাহ করতো। এই কয়েদিরা ছিলো গ্যাস চেম্বার আর শব-চুল্লিতে নিযুক্ত লোক। আর তারা জানতো যে একদিন পালা বদল হয়ে তারা তাদের কাজ থেকে অব্যাহতি পাবে। আর তাদের উপর চাপিয়ে দেয়া জল্লাদের ভূমিকা ত্যাগ করে নিজেদের হতে হবে অন্য জল্লাদের শিকার।
আমাদের গাড়ির প্রায় সবাই এই বিভ্রান্তিতে ছিল যে অবশেষে হয়তো তাদের শাস্তি মৌকুফ করা হবে ও সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। আর এখন যে দৃশ্য দেখছি তার গোপন অর্থ আমরা বুঝতে করতে পারছিনা। একজন উচ্চপদস্থ SS কর্মকর্তার সামনে দিয়ে দ্রুত হেটে যাওয়ার জন্য ট্রেনের ভেতরে লাগেজ রেখে আমাদের দুই সারিতে দাঁড়াতে বলা হলো—এক পাশে মহিলা, অন্যপাশে পুরুষ। আশ্চর্যজনকভাবে, আমার পিটে বহন করার ব্যাগটি আমি পরিহিত কোটের নিচে লুকিয়ে রাখার সাহস করেছিলাম। একজন একজন করে আমার সারির সবাই কর্মকর্তাটির সামনে দিয়ে হেটে গেলো। আমি বুঝতে পারলাম যে আমার ব্যাগটি কর্মকর্তার নজরে পড়লে আমার বিপদ হবে। আমার পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকেই আমি তা অনুমান করতে পেরেছিলাম। স্বাভাবিকভাবে, আমি নিজেকে সোজা রেখে কর্মকর্তার দিকে এগিয়ে গেলাম যেন সে আমার কোটের ভেতরে ভারি বোঝাটি লক্ষ্য করতে না পারে। তারপর আমি তার মুখোমুখি হলাম। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন উর্দিতে তিনি দেখতে ছিলেন এক লম্বা-চওড়া কৃশকায় মানব। আমরা যারা দীর্ঘ যাত্রার পর অগোছালো আর মলিন হয়ে পড়েছিলাম তাদের সাক্ষাতে কর্মকর্তার কি বৈপরীত্য! তিনি বাম হাত দিয়ে তার ডান কনুইয়ে ঠেস দিয়ে এক উদাসীন স্বাচ্ছন্দময় মনোভাব ধারণ করলেন। তাঁর ডান হাত ছিল উপরে উঠানো আর সেই হাতের আঙ্গুল দিয়ে অলস-ভাবে তিনি ডান বা বাম দিকে ইশারা করলেন। একজন মানুষের যখন-তখন ডানে-বামে আঙুলের ইশারা করার সেই হালকা গতিবিধির পেছনে লুকানো অশুভ অর্থ সম্পর্কে আমাদের কারও সামান্যতম ধারনাও ছিল না। কিন্তু খুব কমই তিনি বাম দিকে ইশারা করলেন।
আমার পালা আসলো। কেউ একজন আমাকে ফিসফিস করে বললো যে ডান পাশে পাঠিয়ে দেওয়ার অর্থ হলো কাজ। আর বাম পাশের সারি হলো কাজ করতে অক্ষম এমন অসুস্থদের জন্য, যাদের পরে বিশেষ এক শিবিরে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। আমি কেবল অপেক্ষা করছিলাম যেন সবকিছু নিজের গতিতে চলে। আমার পেছনে বহন করার ব্যাগটি যা আমি কোটের নিচে লুকিয়ে রেখেছি তার ভারে আমার বাম পাশটা একটু কাত হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু আমি সোজা হয়ে হাটার চেষ্টা করলাম। SS কর্মকর্তাটি আমার দিকে তাকালেন, একটু ইতস্তত মনে হলো, তার হাতদুটো আমার কাদের উপর রাখলেন। আমি স্মার্ট দেখানোর কঠোর চেষ্টা করলাম, আর ধীরে ধীরে তিনি আমার কাঁদ ঘোরালেন যতক্ষণ না আমি ডান মুখি হই, আর আমি সে দিকে ঘুরলাম। তার হাতের আঙ্গুল দিয়ে এদিক-ওদিক খেলা করার অর্থ সে দিন সন্ধ্যায় আমার পরিষ্কার হয়েছিল। তার মানে তা ছিল প্রথম বাছাই, যাকে আমরা আমাদের অস্তিত্ব আর অস্তিত্বহীনতার পক্ষে প্রথম রায় বলতে পারি। আমাদের গাড়ির অধিকাংশ, নব্বই শতাংশ, লোকের কাছে এর মানে ছিল মৃত্যু। কারণ যারা বামপাশের সারিতে ছিল পরবর্তী কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাদের দণ্ডাদেশ কার্যকর করা হবে। যাদের বাম পাশের সারিতে পাঠানো হয়েছিল তাদের স্টেশন থেকে নিয়ে সোজা শব-চুল্লির দিকে যাত্রা করা হলো। ওখানে কাজ করা একজন কয়েদি আমাকে বলে যে শব-চুল্লির ভবনের দরজাগুলিতে ‘স্নানাগার’ শব্দটি লিখা হয়েছে ইউরোপের কয়েকটি ভাষায়। ভবনটিতে প্রবেশের পরপরই পুড়ানো আগে প্রত্যেক বন্দীকে একটি করে সাবান দেওয়া হতো, আর তারপর…তারপর কি হয় তা বর্ণনা করা আমার প্রয়োজন আছে বলে মনে করিনা। এই ভয়াবহতা সম্পর্কে বহু কাহিনী লিখা হয়েছে।
আমাদের নিয়ে আসা ট্রেনটির যে কয়জন লোক বেঁচে গিয়েছিল তারা সেই সন্ধ্যায় যাদের অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তার সত্যতা খুঁজে পাই। কিছু সময় ধরে সেখানে বাস করা কয়েদিদের কাছে আমি জানতে চাইলাম আমার সহকর্মী ও বন্ধু পি. কে কোথায় পাঠানো হয়েছে।
“তাকে কি বাম পাশের সারিতে পাঠানো হয়েছিল”? তিনি জিজ্ঞেস করলেন
“হ্যাঁ”, আমি উত্তর দিলাম।
“তাহলে আপনি তাকে ওখানে দেখতে পাবেন”, আমাকে বলা হলো।
“কোথায়”?
কয়েক’শ গজ দূরে অবস্থিত একটি চিমনির দিকে ইশারা করলো একটি হাত। চিমনিটি থেকে একটি অগ্নিশিখার স্তম্ব পোল্যান্ডের ধূসর আকাশে উড়িয়ে দিলো। আর তা ধোয়ার মতো এক অশুভ মেঘে হারিয়ে গেল। “সেখানেই আপনার বন্ধু, স্বর্গে ভেসে বেড়াচ্ছে”, লোকটি উত্তর দিলেন। তবুও যতক্ষণ না আমাকে সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করা হলো ততক্ষণ আমি তার সত্যতা বুঝতে পারিনি। কিন্তু আমি এখানে আমার যা বলার দরকার নেই তাই বলছি। মনস্তাত্ত্বিক বা মানসিক দৃষ্টিকোণ থেকে স্টেশনে ভোর হওয়ার পর থেকে আমাদের শিবিরে প্রথম রাতের বিশ্রাম পর্যন্ত আমাদের সামনে সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করার ছিল।
SS রক্ষীদের পাহারায় ষ্টেশন থেকে আমাদের তাড়া করা হলো। বৈদ্যুতিক কাঁটাতারের বেড়া পার হয়ে শিবিরের মধ্য দিয়ে গোসল করার ঘাঁটিতে পৌছালাম আমরা। আমরা যারা প্রথম যাচাই-বাছাইয়ের ধাপ অতিক্রম করেছিলাম তাদের জন্য এটাই ছিল প্রকৃত স্নানাগার বা গোসলখানা। আমাদের স্বস্তি বিভ্রম (Illusion of reprive) পুনরায় সত্যি হলো। SS লোকদের প্রায় মুগ্ধকর মনে হলো। শীঘ্রই আমরা তার কারণ খুঁজে পেলাম। যতক্ষণ তারা আমাদের হাতে দামি ঘড়ি দেখতে পেলো আর তা তাদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য সদিচ্ছা-প্রণোদিত সুরে আমাদের প্ররোচিত করতে পারলো ততক্ষণ তারা আমাদের সাথে ভাল আচরণ করেছিল। যেভাবেই হোক, আমরা ভাবতাম, আমারা কি আমাদের সব ধর-সম্পদ তাদের হাতে তুলে দেয়নি, আর কেনই বা অপেক্ষাকৃত ভাল আচরণ করা লোকটি আমাদের ঘড়িটি পাবে না? একদিন সম্ভবত বিনিময়ে সেও কোনো ভাল কাজ করবে আমাদের জন্যে।
উপকক্ষ/অতিথি কক্ষের মতো দেখতে জীবাণুমুক্তকরণ বুথের পাশে একটি ছাউনিতে আমরা অপেক্ষা করছিলাম। কিছু লোক এসে মেঝেতে একটি কম্বল পেতে দিলো। কম্বলের উপর আমাদের সব সহায়সম্পদ, যেমন সকল ঘড়ি আর অলংকার সামগ্রী তাতে নিক্ষেপ করতে হয়েছিল। আমাদের মাঝে অনেক সরল মনা কয়েদিরা জিজ্ঞেস করলো বিয়ের-আংটি, পদক বা শুভকামনার কোনো বস্তু তাদের সাথে রাখতে হবে কিনা। এতে তারা অভিজ্ঞ কয়েদিদের কাছে হাসি-ঠাট্টার পাত্র হয়ে উঠে। আমাদের কাছ থেকে যে সবকিছুই কেড়ে নেয়া হবে কেউই তখন তা উপলব্ধি করতে পারিনি ।
তখন পুরাতন এক কয়েদি, যে আমাদের জিনিসপত্র সংগ্রহ করছিলো তার উপর আমি ভরসা করতে চেষ্টা করলাম। চুপিসারে তার কাছে এসে আমার কোটের ভেতরের পকেটে রাখা পাকানো কাগজের দিকে ইশারা করে বললাম, “দেখুন এটি একটি বৈজ্ঞানিক বইয়ের পাণ্ডুলিপি। আমি জানি আপনি কি বলবেন। আপনি বলবেন যে, জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার কারণে আমার কৃতজ্ঞ হওয়া উচিৎ। আর বলবেন শুধু তাই আমি আমার নিয়তির কাছে প্রত্যাশা করতে পারি। যেকোনো মূল্যে আমাকে এই পাণ্ডুলিপিটি বাঁচিয়ে রাখতে হবে। কারণ তাতে আমার সারা জীবনের পরিশ্রম রয়েছে। ব্যাপারটা কি আপনি বুঝতে পারেন?”
হ্যাঁ, তিনি বুঝতে শুরু করছিলেন। আস্তে আস্তে একটি বিকৃত হাসি তার মুখমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। হাসিটাকে প্রথমে মনে হল করুণাময়। তারপর সে হাসিকে মনে হলো আনন্দের হাসি। তারপর তিনি ব্যঙ্গাত্মক, অপমানকর-ভাবে হাসতে থাকলেন। কিছুক্ষণ হাসার পর তিনি গর্জন করে বলে উঠলেন “Shit”! শিবিরের কয়েদিদের শব্দভাণ্ডারে এটি একটি সর্বদা ব্যবহৃত শব্দ।
আমার ফ্যাকাসে আর আতঙ্কিত মুখ নিয়ে অপেক্ষমাণ সহযাত্রীদের মধ্যে হঠাৎ এক আলোড়ন সৃষ্টি হলো। তারা অসহায়ভাবে বিতর্ক করছে। আবারও, আমরা কারা রক্ষীদের কড়া চিৎকার করা আদেশ শুনতে পেলাম। চড়-ঘুষি দিয়ে আমাদের নিকটবর্তী গোসলখানার ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো। আমরা সেখানে একজন SS কর্মীকে আমাদের জন্য অপেক্ষা করতে দেখলাম। পৌঁছে সেখানে আমরা তার চারপাশে জড়ো হলাম। তারপর তিনি বললেন, “আমি তোমাদের দুই মিনিট সময় দেব আর আমি আমার ঘড়ি অনুসারে দেয়া হবে। এই দুই মিনিটের মধ্যে তোমরা পুরোপুরিভাবে উলঙ্গ হয়ে যার যা আছে তা তোমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছো সেখানে ফেলে দেবে। তোমাদের জুতো, বেল্ট বা কটিবন্ধন এবং সম্ভবত হলে ট্রাস (রোগীর পরিধানের জন্য তুলা ভর্তি নরম বন্ধনী) ছাড়া কোনো কিছু তোমরা সঙ্গে নিতে পারবেনা। আমি গণনা শুরু করছি – এখনই! “
তাড়াহুড়ো করে খুলতে গিয়ে লোকজন তাদের জামা-কাপড় ছিঁড়ে ফেলল। সময় কমে আসার সাথে সাথে তারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে উঠে আর অমার্জিত-ভাবে তাদের অন্তর্বাস, বেল্ট ও জুতোর ফিতা টানাটানি করতে শুরু করে দেয়। তারপরে আমরা প্রথম বারের মতো চাবুকের শব্দ শুনতে পেলাম। কাউকে নগ্ন শরীরে চামড়ার চাবুক দিয়ে পেটানো হচ্ছে।
পরে কামানোর জন্য আমাদের সবাইকে একত্রে অন্য একটি কক্ষে ঢুকানো হলো। সেখানে কেবল আমাদের মাথার চুল ছাটা হয়েছিল এমন নয়, বরং আমাদের পুরো শরীরে কোথাও একটি লোমও বাকি রাখেনি। তারপর গোসলখানায়, যেখানে পুনরায় আমাদের সারিবদ্ধ করা হয়। চুল-দাড়ি-লোম কামানোর পর একে অপরকে চিনতে আমাদের খুবই কষ্ট হয়েছিল। তবে বেশ স্বস্তির বিষয় ছিলো যে কেউ কেউ লক্ষ্য করলো যে গোসলখানার সেচনী থেকে আসলেই জল পড়ছে। স্নানের জন্য অপেক্ষায় থাকা অবস্থায় আমাদের শরীরকে আমরা প্রকৃত অর্থে বুঝতে পারি। আমরা বুঝতে পারি যে, আমাদের নগ্ন শরীর ব্যতীত আমাদের আর কিছুই নেই। যার উপর আমাদের অধিকার আছে তা হলো আক্ষরিক অর্থে আমাদের নগ্ন জীবন। আমাদের জীবনে বস্তুগত সম্পর্ক হিসেবে আমাদের জন্য আর কি অবশিষ্ট রইল? আমার বেলা যে দুটি বস্তু আমার জন্য অবশিষ্ট ছিল তা হল আমার চশমা ও একটি বেল্ট।