Last updated on January 24th, 2024 at 02:19 pm
পরবর্তীতে অবশ্য একটি রুটির জন্য চশমাটি বিনিময় করতে হয়েছিল। যাদের কাছে রোগীর পরিধানের জন্য তুলা ভরতি নরম বন্ধনী বা ট্রাস ছিল, তাদের ভাগ্যে একটু বেশী আনন্দ ছিল। সন্ধ্যায় আমাদের ছাউনির দায়িত্বে থাকা একজন বয়স্ক কয়েদি একটি বক্তব্য দিয়ে আমাদের স্বাগত জানান। সেই বক্তব্যে তিনি বীম বা কড়িকাঠের দিকে ইশারা করে প্রতিজ্ঞা করে বলেন যে, কেউ যদি ট্রাসের ভেতর কোনো অর্থ বা মূল্যবান সোনা-রোপা সেলাই করে লুকিয়ে রাখে তাহলে তিনি ব্যক্তিগতভাবে তাকে বীম থেকে ঝুলিয়ে ফাঁসি দেবেন। গর্বের সাথে তিনি উল্লেখ করেন যে শিবিরের একজন পুরনো বাসিন্দা হিসেবে আইন তাকে তা করার অধিকার দিয়েছে।
আমাদের জুতো যেখানে সম্পৃক্ত, ব্যাপারগুলি এত সহজ ছিল না কারণ অনেককে জুতোও খুলে দিতে হয়েছিল। আমাদের জুতো রাখার কথা থাকলেও, যাদের মোটামুটি মার্জিত জুতো ছিল অবশেষে তাও তাদের ছেড়ে দিতে হয়েছিল। আর তার বিনিময়ে তাদের এমন জুতো দেওয়া হয়েছিল যা তাদের পায়ের সাথে মিলত না। যেসব নতুন কয়েদিরা পুরাতন কয়েদিদের দেওয়া স্পষ্টতই ভাল পরামর্শ অনুসরণ করেছিল এবং নাশকতা লুকাতে জ্যাক-বুটের উপরটা কেটে ছোট করে কাটা প্রান্তে সাবান লেপে দিত তারাই ছিল প্রকৃত যন্ত্রণার কারণ। SS এর লোকেরা মনে হয় শুধু তার জন্যই অপেক্ষা করেছিল। এই অপরাধে অপরাধী সবাইকে পার্শ্ববর্তী ছোট একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আর কিছুক্ষণ পর আমরা আবার চাবুক মারার এবং অত্যাচারিত পুরুষদের চিৎকার শুনতে পাই। এবার তা বেশ কিছুক্ষণ স্থায়ী হয়।
এইভাবে, আমাদের মাঝে যারা তখনও স্বস্তি ভ্রমকে (Illusion of reprieve) আঁকড়ে ধরে রেখেছিল তারা একে একে সবাই ধ্বংস হয়ে গেলো। এবং তারপরে, বেশ অপ্রত্যাশিতভাবে, আমাদের বেশিরভাগই এক ভয়ানক রকমের রসিকতা দ্বারা ধরাশায়ী হয়ে পড়লো। আমরা জানতাম যে হাস্যকর এক নগ্ন জীবন ছাড়া আমাদের হারানোর কিছু নেই। গোসলখানার স্প্রে চালু করে হলে আমরা একে অন্যের সম্পর্কে মজা করার জন্য খুব চেষ্টা করলাম। বলা চলে যে স্প্রে থেকে ঠিকই প্রকৃত জল প্রবাহিত হয়েছিল!
সেই অদ্ভুত রকমের রসিকতা ছাড়াও আরেক সংবেদন-শক্তি আমাদের জব্দ করে: জানার কৌতূহল। নির্দিষ্ট কোনো অজানা পরিবেশের প্রতি মৌলিক প্রতিক্রিয়া হিসাবে আমি এর আগেও এই ধরনের কৌতূহল অনুভব করেছিলাম। এক সময় পাহাড়ে উঠতে গিয়ে দুর্ঘটনা কবলিত হয়ে আমার জীবন বিপদগ্রস্ত ও বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। সেই কঠিন মুহূর্তেও কৌতূহল নামের এই সংবেদনশক্তিকে (sensation) আমি ভীষণভাবে অনুভব করেছিলাম। এ বিপদ থেকে আমি জীবিত অবস্থায় ফিরে আসব কি না, ফাটা মাথার খুলি বা অন্য কোনো আঘাত বয়ে নিয়ে আমাকে বেচে থাকতে, এসবের কৌতূহল আমাকে ঘিরে ধরেছিল ।
কিভাবে জানি মনকে এর পরিবেশের চারপাশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে, আমার শীতল এই কৌতূহল অশউইৎয শিবিরেও প্রাধান্য পেয়েছিল। এই কৌতূহলকে এক ধরনের বস্তুনিষ্ঠতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। সেই সময় কোনো ব্যক্তি কৌতূহল নামের এই মানসিক অবস্থাকে আত্মরক্ষার উপায় হিসেবে এর অনুশীলন করতো। যেমন ধরুন, গোসলের পর ভিজা অবস্থায় পড়ন্ত শরতের হিমেল আবহাওয়ায় খোলা বাতাসে আমাদের সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকার ফলে পরে আমাদের কি হতে তা জানার জন্য আমরা ব্যাকুল ছিলাম। পরবর্তী কয়েক দিনের মধ্যে আমাদের কৌতূহল বিস্ময়ে পরিণত হলো; আশ্চর্যের ব্যাপার হলো ঠাণ্ডা বাতাসে দাড়িয়ে থাকতেও আমাদের ঠাণ্ডা লাগেনি।
শিবিরে নতুন আগতদের নিয়তি বিভিন্ন রকমের বিস্ময়ে ভরা ছিল। আমাদের মধ্যে চিকিৎসকরাই সর্ব প্রথম বুঝতে পেরেছিলাম যে, “আমাদের পাঠ্যপুস্তক মিথ্যা কথা বলে!” পাঠ্যপুস্তকের কোথাও কোথায় বলা হয়েছে যে, মানুষ ঘুম ছাড়া নির্দিষ্ট একটি সময়ের বেশি ঠিকে থাকতে পারে না। কথাটি ঠিক নয়! আমাকে শেখানো হয়েছিল যে কিছু কিছু জিনিস আমি ইচ্ছা করলেও করতে পারবো না। যেমন ধরুন আমরা প্রায় বলে থাকি, “এটা না হলে আমি ঘুমাতে পারব না, বা এটা-ওটার সাথে আমি বাঁচতে পারবো না। যেখানে অশউইৎয শিবিরে প্রথম রাতে আমরা তিন-স্তর বিশিষ্ট একটি বিছানায় ঘুমিয়েছিলাম। প্রতিটি স্তর ছিল প্রায় সাড়ে ছয় থেকে আট ফুট। বিছিয়ে দেওয়া তক্তার উপর প্রতি স্তরে নয়জন করে মানুষ ঘুমাত। প্রতি নয়জন বন্দীকে দুটি কম্বল ভাগাভাগি করে থাকতে হতো। আমরা কেবলই পাশ/কাঁত হয়ে শুতে পারতাম। তীব্র শীতের কারণে জনাকীর্ণ পরিবেশ আর একে অপরের সাথে গাদাগাদি করে শোয়ার মাঝে কিছু সুবিধাও ছিল। বিছানায় জুতো নিয়ে উঠার নিষেধ থাকলেও, কাদায় আবৃত থাকার পরও কেউ কেউ গোপনে তা বালিশ হিসাবে ব্যবহার করতো। অন্যথায়, তাকে প্রায় মচকে যাওয়া হাতের বাঁকের উপর মাথা রাখতে হতো। আর তবুও বিস্মৃতি নিয়ে ঘুম আসে আর নিয়ে আসে কয়েক ঘণ্টা স্বস্তি ।
আমরা কতটা কষ্ট সহ্য করতে করতে পেরেছিলাম সে সম্পর্কে আমি কয়েকটি বিস্ময়কর ঘটনার কথা উল্লেখ করতে চাই। প্রতিদিন দাঁত মাজা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিলনা। তারপরও প্রকট ভিটামিনের অভাব থাকা সত্ত্বেও আমাদের দাঁতের মাড়ি ছিল আগের চেয়ে স্বাস্থ্যকর। বছরের পর বছর ধরে আমাদের একই শার্ট পরতে হয়েছিল, যতদিন না শার্ট হিসেবে এর সমস্ত উপস্থিতি বিলীন হয়েছে। পানির পাইপে বরফ জমে যাওয়ার কারণে কয়েক দিন ধরে গোসল করতে না পারলেও হাতে ঘা হয়নি। হিম-দংশ বা বরফের আঘাতে তা না হয়ে থাকলে মাটিতে কাজ করার দরুন ত্বকে ফোড়া বা পচন রোগ হয়নি। অথবা উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক হালকা কোলাহলে সহজেই ঘুম ভেঙ্গে যায় এমন কোনো ব্যক্তির কথা। যে হয়তো পাশের ঘরে থেকে সামান্য তম নাকডাকার শব্দেও তিনি বিরক্ত হতেন। এখন সে তার কান থেকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দুরে জোরে জোরে নাক-ডাকা একজন সঙ্গীর গা ঘেঁসে শুয়ে আছে আর কোলাহলের মধ্যেও দিব্যি ঘুমাচ্ছে।
যারা ফিওদর দস্তোয়ভস্কি মানুষকে এমন এক সত্ত্বা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন, যে যেকোনো কিছুতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারে। কেউ যদি দস্তোয়ভস্কির এই উক্তির সত্যতা সম্পর্কে জানতে চান তার উত্তরে আমরা বলবো, “হ্যাঁ”। একজন মানুষ যেকোনো কিছুতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেতে পারে। তবে কীভাবে অভ্যস্ত হয়ে উঠে তা আমাদের জিজ্ঞেস করবেন না”। কারণ তা জানার জন্য আমাদের মনস্তাত্ত্বিক গবেষণা আমাদের এখনো তত-দূর নিয়ে যায়নি। আমরা কয়েদিরাও সেই অবস্থানে পৌঁছাতে পারিনি। শিবিরে আমরা তখনও মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়ার প্রাথমিক স্তরে ছিলাম।
শিবিরে আমরা প্রায় প্রত্যেকেই আত্মহত্যার চিন্তাটি পোষণ করেছিলাম, যদিও কেবল অল্প সময়ের জন্য। নিরাশ পরিস্থিতি থেকে এরকম চিন্তার সৃষ্টি হয়। ক্রমাগতভাবে প্রতিদিন আর প্রতিক্ষণে মৃত্যুর বিপদ আমাদের উপর আবির্ভূত হচ্ছিল আর অনেকেই এই মৃত্যুর মুখোমুখিও হয়েছিলো। আমি যেমনটা আগেও বলেছি যে আমার ব্যক্তিগত প্রত্যয় থেকে শিবিরে আগমনের প্রথম সন্ধ্যায় আত্মহত্যা করার সহজ উপায় হিসেবে বিবেচিত বৈদ্যুতিক কাঁটাতারের বেড়ায় গিয়ে ধাক্কা বা ঝাপ না খাওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। “কাঁটাতারের বেড়ায় ঝাপ দিয়েছে” কথাটি ছিল বৈদ্যুতিক কাঁটাতারের স্পর্শ করে আত্মহত্যা করাকে ব্যাখ্যা করার জন্য এটি ছিল শিবিরে একটি প্রচলিত কথা। এই সিদ্ধান্ত নেওয়া আমার পক্ষে পুরোপুরি কঠিন ছিল না। কারণ আত্মহত্যা করার খুব কমই কারণ ছিল সেখানে। বস্তুনিষ্ঠ-ভাবে হিসেব করলে ও সম্ভাব্য সব সম্ভাবনার অঙ্ক কষলে দেখা যায় যে গড় বন্দীদের জীবনায়ু ছিল খুবই নগণ্য। কোনও আশ্বাসই একজন মানুষ সকল যাচাই-বাছাই থেকে রক্ষা পাওয়া মানুষের ক্ষুদ্র অংশের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার প্রত্যাশা করতে পারতো না। প্রচণ্ড মানসিক ধাক্কা বা shock এর প্রথম স্তরে এসে অশউইৎয শিবিরের একজন কয়েদি মৃত্যুকে ভয় পায়নি। এমনকি প্রথম কয়েক দিন পর গ্যাস চেম্বারগুলির ভয়াবহতা তাকে বিচলিত করতে পারেনি। সে কারণে চেম্বারগুলি একজন মানুষকে পুড়িয়ে মেরে আত্মহত্যার কাজ থেকে বাঁচিয়ে রাখতো।
পরতীতে বন্ধুদের সাথে সাক্ষাৎকালে তারা আমাকে বলে যে, শিবিরে প্রবেশের প্রচণ্ড মানসিক ধাক্কা বা shock যে সমস্ত লোকদের প্রবলভাবে বিষণ্ণ করে তুলেছিল, আমি তাদের মধ্যে নাই। কারণ সে পরিস্থিতি আমাকে বিষণ্ণ করে তুলতে পারেনি। অশউইৎয শিবিরে আমাদের প্রথম রাতের পর সকালে যখন পরবর্তী ঘটনাটি ঘটে তখন আমি বেশ আন্তরিকতার সাথে শুধু মুচকি হেসেছিলাম। ‘ব্লক’ বা ছাউনি ত্যাগ না করার জন্য কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়া সত্যেও কয়েক সপ্তাহ আগে আসা আমার একজন মহকর্মী চুপিসারে আমাদের ছাউনিতে প্রবেশ করলেন। তিনি আমাদের শান্ত করতে এবং সান্ত্বনা দিতে ও আমাদের কয়েকটি কথা বলতে চেয়েছিলেন। তিনি এতটাই রোগা হয়ে গিয়েছিলেন যে প্রথমে আমরা তাকে চিনতে পারিনি। বেশ রসিকতা আর বেপরোয়া ভঙ্গিতে তিনি তাড়াহুড়ার সাথে আমাদের কয়েকটি উপদেশ দিলেন। তিনি বললেন, “ভয় পাবেন না! যাছাই-বাছাই প্রক্রিয়াকে ভয় করবেন না! ডাক্তারদের জন্য SS মেডিকেল প্রধান ডাঃ.এম’র দুর্বলতা (দয়া) আছে”। (তথ্যটি আসলে ভুল ছিল। আমার সহকর্মীটির সদয় বাণী ছিল বিভ্রান্তিকর। একজন প্রায় ষাট বছরের ছাউনি ব্লকের কয়েদি ডাক্তার আমাকে বলেছিলেন কীভাবে তিনি ডাঃ এম. এর কাছে তার ছেলেটিকে গ্যাস চেম্বারে না পাঠিয়ে ছেড়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। তার অনুরোধ সত্ত্বেও ডাঃ.এম. অবলীলায় তা প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছিলেন।)
“কিন্তু একটা জিনিস আমি আপনাকে অনুরোধ করি”,তিনি বলতে থাকলেন, “সম্ভব হলে প্রতিদিন দাড়ি কামাবেন, এমনকি তা যদি একটুকরো গ্লাস দিয়েও করতে হয় ..এমনকি আপনাকে তার জন্য তোমার রুটির শেষ টুকরোটাও যদি ত্যাগ হয় তবুও। তাতে আপনাকে আরও যুবক দেখাবে আর টসটসে স্বাস্থ্যবান দেখাবে আপনাকে। বেঁচে থাকতে চাইলে আপনার একটাই উপায় আছে। আর তা হলো কাজের জন্য সবল থাকা। যদি গোড়ালিতে ফোসকার কারণে খোঁড়াতে থাকেন আর যদি তা কোনো SS এর লোকের চোখে পড়ে, তাহলে আপনাকে আলাদা করে রাখবে আর পরের দিন নিশ্চিত আপনাকে গ্যাস দিয়ে মারা হবে। আপনি কি জানের একজন ‘মোসলেম’ বলতে আমরা কি বোঝাতে চাই? যাকে দেখতে একজন দুর্দশাগ্রস্ত, নিঃস্ব, অসুস্থ এবং ক্ষীণ, ও যে আর কঠোর শারীরিক পরিশ্রম করতে পারে না তাকেই একজন ‘মোসলেম’ বা ‘মোসেলমান’ বলা হয়। আজ হোক বা কাল, প্রত্যেক ‘মোসলেম’র ঠিকানা হলো গ্যাস চেম্বার। যা সাধারণত তাড়াতাড়ি হয়ে থাকে। তাই প্রতিদিন শেভ করবেন, শক্ত হয়ে দাঁড়াবেন এবং চটপটে চলাফেরা করবেন। তারপর আপনাকে আর গ্যাসের ভয় করতে হবে না। আপনারা যারা এখানে দাঁড়িয়ে আছেন নিজেদের ব্যতীত আপনাদের গ্যাসের ভয় পাওয়ার প্রয়োজন নেই। কেবল চব্বিশ ঘণ্টা আগেও যদি আপনারা এসে থাকেন। মনে রাখবেন আপনারা নিজেরাই নিজেদের ভয়।” তারপর তিনি আমার দিকে ইশারা করলেন আর বললেন “আশা করি খোলাখুলি-ভাবে এসব কথা বলার কারণে আপনি কিছু মনে করেননি”। অন্যদের তিনি পুনরায় বললেন, “আপনাদের মাঝে শুধু তার জন্যই পরবর্তী বাছাইয়ে ভয় রয়েছে। তাই কোনো চিন্তা করবেন না”।
আমি আবারও মুসকি হাসলাম। এখন আমি নিশ্চিত যে সেদিন তিনি আমার জায়গায় হলে ঠিক একই জিনিসটাই করতেন।
*******
আমার মনে হয় জার্মান লেখক ইফ্রেম লেসিং একথা বলেছিলেন যে, “জীবনে এমন কিছু জিনিস রয়েছে যার জন্য আপনি যুক্তি হারাতে বাধ্য হন অথবা আপনার হারানোর কিছুই থাকেনা ”। অস্বাভাবিক পস্থিতির প্রতি অস্বাভাবিক সাড়া জীব জীবনে একটি স্বাভাবিক আচরণ। এমনকি আমরা মনোরোগ বিশেষজ্ঞরাও আশা করি যে পাগলাগারদে নিবেদিত এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতির প্রতি একজন ব্যক্তির প্রতিক্রিয়া তার স্বাভাবিকতার মাত্রার অনুপাতে অস্বাভাবিক হোক। বন্দী শিবিরে অবস্থানের প্রতি একজন মানুষের প্রতিক্রিয়াও এক অস্বাভাবিক মানসিক অবস্থার প্রকাশ। কিন্তু বস্তুগত দিক থেকে বিচার করলে, এটি একটি স্বাভাবিক ও কোনো প্রদত্ত পরিস্থিতির প্রতি এক সাধারণ প্রতিক্রিয়া — যা নিয়ে পরে আলোচনা করা হবে। আমি যেমনটি বর্ণনা করেছি, কয়েদিদের এই প্রতিক্রিয়া সমূহ অল্প কিছু দিনের মধ্যেই পরিবর্তন হতে শুরু করলো। এর মধ্যে কয়েদিরা তাদের মানসিক অবস্থার প্রাথমিক ধাপ পার হয়ে দ্বিতীয় স্তরে পৌছে গেছে। দ্বিতীয় স্তরটি একটি তুলনামূলকভাবে মানসিক উদাসীনতার স্তর, সেখানে একজন কয়েদি একধরনের আবেগজনিত মৃত্যু (emotional death) লাভ করে।
ইতিমধ্যে বর্ণিত মানসিক প্রতিক্রিয়া ছাড়াও নতুন আগত কয়েদিদের নির্যাতনের সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক আবেগের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। যে কারণে তার আবেগ হয়ে উঠে নিঃসাড় বা অনুভূতিহীন। শিবিরের প্রবেশের প্রথম প্রথম বাড়ি আর পরিবারে জন্য তার সীমাহীন আকাঙ্ক্ষা ছিল। সে আকাঙ্ক্ষা কখনও কখনও এতই তীব্র হয়ে উঠত যে এই তা তাকে গ্রাস করে বসতো। তারপর আসে ঘৃণা, অপমান; তার চারপাশের সকল কুৎসিত বাহ্যিক আকৃতির প্রতি তার ঘৃণা আর অপমান চলে আসে।
অধিকাংশ বন্দীদের নেকড়ার তৈরি একটি করে উর্দি বা ইউনিফর্ম দেওয়া হয়েছিল। তুলনামূলকভাবে যা এক কাকতাড়ুয়াকে সুন্দর মানাত। আমি লক্ষ্য করলাম শিবিরের ছাউনির মাঝখানে পড়ে আছে মল। একজন মানুষ যত বেশি তা পরিষ্কার করে ফেরার চেষ্টা করেছে তত বেশি তাকে এর সংস্পর্শে আসতে হয়েছে। ছৌচাগার পরিষ্কার এবং নর্দমা নিষ্কাশনের জন্য কাজের দলে আসা এক নতুন আগন্তুকের কাছে এর বিবরণ করাটা ছিল একটি প্রিয় প্রথা। সাধারণত, উঁচু-নিচু মাঠ দিয়ে বহন করে নিয়ে যাওয়ার সময় দু’য়েক ফোটা মল তার মুখে ছিটকে পড়ার কারণে সে বন্দীর মুখে যদি কোনো ঘৃণার চিহ্ন দেখা যেতো বা যদি সে মল মুছে ফেলার কোনো প্রচেষ্টা করতো তাহলে তার জন্য শাস্তি হিসেবে তাকে ক্যাপোদের কাছ থেকে বেতের বারি সহ্য করতে হতো। আর এইভাবে, পরিস্থিতির প্রতি স্বাভাবিক মানসিক প্রতিক্রিয়ার অপমান বোধকে বাড়িয়ে তুলতো।
প্রথম প্রথম একজন কয়েদি আরেক দলকে শাস্তি ভোগ করতে দেখলে তা থেকে সে তার মুখ ফিরিয়ে নিতো। সহ-বন্দীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাদার মধ্যে কুচকাওয়াজ করতে দেখলে,এবং বেতের আঘাতে নিয়ন্ত্রিত তাদের চলাফেরার দৃশ্য দেখলে সে সহ্য করতে পারতো না। কয়েকদিন বা কয়েক সপ্তাহ পর অনেক জিনিসে পরিবর্তন আসে। দেখা যায় যে, খুব ভোরে অন্ধকার থাকা অবস্থায় তার বিশেষ সৈন্য দলের সাথে কুচকাওয়াজ করার জন্য সে ফটকের সামনে প্রস্তুত হয়ে আছে। হঠাৎ চিৎকার শুনতে পেয়ে সে যখন দেখে যে তার একজন সহ-বন্দী মাটিতে পড়ে রয়েছে। সে পুনরায় তার পায়ে দাঁড়াল, আর আবারও তাকে বেত দিয়ে আঘাত করা হলো–কেনো? কারণ তার জ্বর হয়েছিল। আর অসময়ে সে অসুস্থদের জন্য ব্যবহৃত হওয়া ঘরে গিয়ে তা জানিয়েছিলো। আর অসুস্থতার কারণে তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাওয়ার এই বেআইনি চেষ্টার জন্য তাকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।
কিন্তু যে কয়েদি তার মানসিক প্রতিক্রিয়ার দ্বিতীয় স্তরের পদার্পণ করেছে, সে এরকম ভয়াবহতা দেখে আগের মতো আর চোখ ফিরিয়ে আনেনি। এর মধ্যে তার সব অনুভূতি ভোঁতা হয়ে গেছে, আর অবিচলভাবে সে সব নির্মমতা দেখে চলছে। আরও একটি উদাহরণ দেওয়া যাক: ধরা যাক একজন কয়েদি কোনো আঘাত বা ইডেমা বা জ্বরের কারণে দুই দিনের জন্য শিবিরের ভেতরে করা যায় এমন কোনো হালকা কাজের প্রত্যাশায় অসুস্থদের জন্য ব্যবহৃত হয় ঘরে (sick-bay) অপেক্ষা করছে। জোর করে ঘণ্টার পর ঘনটা সাবধানে দাঁড় করো রাখা এক বারো বছরের শিশুকে শিবিরে তার জন্য কোনো জুতো না থাকার দরুন খালি পায়ে বাইরে কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। শিশুটিকে যখন তাকে বহন করে ভেতরে নিয়ে আসা হলো তখনও মানসিক প্রতিক্রিয়ার দ্বিতীয় স্তরের পদার্পণ করা কয়েদি অবিচলভাবে দাঁড়িয়ে থেকেছিল। শিশুটির পায়ের আঙ্গুলগুলি তুষারাবৃত হয়ে গিয়েছিল। আর কর্তব্যরত ডাক্তার একে একে টুইজার দিয়ে কালো কালো পচনশীল অংশ সমূহ একের পর এক তুলে নিলেন। ঘৃণা, আতঙ্ক এবং করুণার মতো আবেগকে আমাদের মতো কয়েদি দর্শক সত্যিই আর অনুভব করতে পারেনি। কয়েক সপ্তাহের শিবির জীবনের পরে যন্ত্রণার শিকার মানুষ, মরে যাওয়া বা মৃত্যু তার কাছে এতই স্বাভাবিক হয়ে উঠে যে এসব ঘটনা তাকে আর বিচলিত করতে পারে না।
আমি কিছু দিন টাইফাস রোগীদের সাথে কাটিয়েছিলাম। টাইফাস রোগীদের উচ্চমাত্রার জ্বর আসতো আর প্রায় সময় রোগীরা প্রলাপ বকত, যাদের অনেকেরেই অবস্থা ছিল প্রায় যায় যায়। একজন রোগীর মৃত্যুর পর আমি কোনো ধরনের মনখারাপ না করে পরবর্তী ঘটনাটি লক্ষ্য করছিলাম। যে ঘটনাটি প্রতিবার কারও মৃত্যুর পর পুনরাবৃত্তি হচ্ছিল। আমি দেখলাম যে কারও মৃত্যুর পর কয়েকজন কয়েদি একে একে তখনও উষ্ণ দেহটির দিকে এগিয়ে গেলো। একজন তার আলুর নোংরা খাবারের অবশিষ্ট অংশটা কেড়ে নিলো। অন্য আরেকজন ভাবলো লাশের পাশে কাঠের জুতোগুলি তার জন্য সুবিধাজনক হবে। তাই সে নিজের জুতোর সাথে লাশের জুতোগুলি বিনিময় করে নিলো। তৃতীয়-জনও ঠিক তাই করলো। সে মৃত ব্যক্তির কোটটি নিয়ে নিলো, আর অন্যজন কিছু দড়ি আয়ত্ত করতে পেরে আনন্দিত ছিল।
এই সব আমি উদ্বেগ-হীনভাবে দেখেছিলাম। অবশেষে আমি “নার্স” কে মৃত দেহটি সরিয়ে ফেলতে বলেছিলাম। সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর নার্সটি লাশটিকে নোংরা টাইফাস রোগীদের তক্তার বিছানার দুই সারির মাঝখানের ছোট করিডোর দিয়ে দুই পা ধরে টেনে টেনে দরজার দিকে উঁচুনিচু মাটির মেঝেতে নিয়ে যায়। বারংবার খাদ্য সংকটের কারণে আমরা খুবই ক্লান্ত ছিলাম বলে খোলা আকাশে দিকে চলে যাওয়া দু’টি সিঁড়ি বেয়ে উঠতে সবসময়ই আমাদের সমস্যা হতো। শিবিরে কয়েকমাস কাটার পর আমরা নিজেদের টেনে তুলার জন্য দরজার বাজু না ধরে সিঁড়িগুলি বেয়ে উঠতে পারতাম না। সিঁড়ি দু’টির উচ্চতা ছিল প্রায় ছয় ইঞ্চি।
মৃতদেহ সহ নার্সটি সিঁড়ি দু’টির কাছে আসলো। তারপর ক্লান্তিকর-ভাবে সে নিজেকে উপরে টেনে তুলে। তারপর প্রথমে লাশটির পা, তারপর শরীর এবং অবশেষে বিদঘুটে বকবক শব্দ করে লাশের মাথা সিঁড়ি দু’টির উপরে তুলে নিয়ে আসলো।
মেঝের পাশে ছাউনির বিপরীতে একমাত্র জানালার অদূরে আমার বাসস্থান ছিল। ঠাণ্ডা হাতে সুপের বাটিতে চুমুক দিতে দিতে আমি জানালার বাইরে তাকালাম। একটু আগে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া লাশটি তখনও স্বচ্ছ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দু’ঘণ্টা আগেও আমি লোকটার সাথে কথা বলেছিলাম। এখন আমি সুপের বাটিতে চুমুক দিয়ে চলছি আর সে মৃত।
**********
আমার আবেগহীনতা (Apathy) যদি আমার পেশাগত আগ্রহের দিক থেকে আমাকে আকর্ষণ না করতো, তাহলে আমি এ ঘটনা মনে রাখতাম না কারণ তাতে খুব কমই অনুভূতি সম্পৃক্ত ছিল।
বেদনাবোধহীনতা বা অনুভূতিহীনতা (Apathy) হলো আবেগ আর অনুভূতিকে স্থূল বা ভোঁতা করে তোলার মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়া, যার লক্ষণ বন্দীদের মানসিক প্রতিক্রিয়ার দ্বিতীয় স্তরে প্রকাশ পায়। অবশেষে এই বেদনাবোধহীনতা বা অনুভূতিহীনতা তাকে প্রতিদিনের ও প্রতি মুহূর্তের প্রহারের প্রতি অসংবেদনশীল (insensitive) করে তুলতো। এই অসংবেদনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে দ্রুত একজন বন্দী নিজেকে প্রয়োজনীয় প্রতিরক্ষামূলক খোলস দিয়ে পরিবেষ্টিত করে রাখতো।
খুব সামান্যতম উস্কানি বা অনেক সময় কোনো কারণ ছাড়াই প্রহার করার ঘটনা ঘটতো শিবিরে। যেমন ধরুন, কাজ করার স্থানে রুটি ভাগ করে দেওয়া হলো আর তার জন্য আমাদের লাইনে দাঁড়াতে হলো। একবার, আমার পেছনের লোকটি একপাশ দিয়ে একটু দুরে দাঁড়িয়েছিলো আর লাইনের সে ভারসাম্যহীনতা SS রক্ষীকে অসন্তুষ্ট করে। আমি তখনও জানতাম না আমার পেছনের সারিতে বা SS রক্ষীর মনে কি ঘটছিল। কিন্তু হঠাৎ দুইটা তীব্র বারি আমার মাথার উপর এসে পড়েছিল। আর কেবল তখনই রক্ষীটিকে দেখি আমার পাশে কারও উপর তার লাটি ব্যবহার করতে। এরকম মুহুর্তে শারীরিক যন্ত্রণার চেয়ে যে জিনিসটি সবচেয়ে কষ্ট দিতো তা হলো অন্যায়-অবিচারের দরুন সৃষ্ট মানসিক যন্ত্রণা, আর সকল অবিচারের যুক্তিহীনতা।
আশ্চর্যজনকভাবে, কোনো কোনো পরিস্থিতিতে যে আঘাতের কোনো চিহ্ন হয় না, সেই আঘাতটি চিহ্ন একে দেওয়া আঘাতের চেয়ে বেশি কষ্ট দিতো। তুষারঝড়ের সময় আমি একসময় এক রেল লাইনের উপর অপেক্ষা করছিলাম। বৈরি আবহাওয়া সত্ত্বেও আমাদের কাজের দলকে কাজ চালিয়ে যেতে হয়েছিল। নুড়ি পাথর দিয়ে রেল লাইনে আমি বেশ কঠোর পরিশ্রম করেছিলাম। কারণ শীতের মাঝে নিজেকে উত্তপ্ত রাখার জন্য কাজই ছিল একমাত্র উপায়। বেলচার উপর নির্ভর করে আমি দম নেওয়ার জন্য এক মূহুর্তের জন্য কাজ থামিয়ে দিয়েছিলাম। দুর্ভাগ্যবশত: ঠিক সেই মুহূর্তেই প্রহরীটি ঘুরে দাঁড়িয়ে ভাবলেন আমি কাজে ফাঁকি দিচ্ছি। যে যন্ত্রণা সে তখন আমাকে দিয়েছিল তা কোনো অপমান বা আঘাতের যন্ত্রণা ছিলনা। তার সামনের দাঁড়িয়ে থাকা আকৃতিটি যা হয়তো তাকে অস্পষ্টভাবে কোনো মানুষের কথা স্মরণ করিয়েছিল সেই কৃশকায়, ক্ষীণদেহের মানুষটিকে কিছু বলার জন্য চিন্তা করা উপযুক্ত সে মনে করেনি। সে বরং খেলাচ্ছলে একটি পাথর কুড়িয়ে নিলো আর আমাদের দিকে ছুড়ে মারল। আমার কাছে তা মনো হলো যেন কোনো গৃহপালিত জন্তুর কাছে তার কাজ শেষ করার জন্য দৃষ্টি আকর্ষণের ডাক। পশুটি এমন এক সৃষ্টি যার সাথে আপনার এতই অমিল রয়েছে যে আপনি তাকে শাস্তি দেওয়ারও উপযুক্ত মনে করেন না।
প্রহারের ক্ষেত্রে সব চেয়ে যন্ত্রণাদায়ক অংশটি হলো এর সাথে সম্পৃক্ত অপমান। একসময় আমাদের বরফে ঢাকা পথের উপর কিছু লম্বা আর ভারি বিম (গার্ডার) বহন করে নিয়ে যেতে হয়েছিল। যদি কেউ একজন পিছলে পড়ে তাহলে সে কেবল নিজেকে নয় বরং বিমটি বহনরত অন্যান্য সবাইকেই বিপদে ফেলতো। জন্মগতভাবে আমার এক পুরনো বন্ধুর কোমর সঠিক স্থান থেকে বিচ্যুত ছিল। তা সত্ত্বেও সে কাজ করতে সমর্থ হওয়াই আনন্দিত ছিল। যেহেতু কোনো যাচাইয় বাছাই প্রক্রিয়ার পর শারীরিকভাবে অক্ষম সবাইকে অনেকটা নিশ্চিতভাবে গ্যাস চেম্বারে মৃত্যুতে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। ভারি বিমটি বহন করার সময় সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিল, আর মনে হচ্ছিল সে প্রায় পড়ে যাবে এবং অন্যদেরও তার সাথে টেনে নিয়ে যাবে। তখন যেহেতু আমি বিম বহনের কাজে ছিলাম না তাই আমি কাল-বিলম্ব না করে তার সাহায্যে লাফিয়ে উঠলাম। তৎক্ষণাৎ আমার পিঠে আঘাত করা হলো, কর্কশভাবে আমাদের গালিগালাজ করা হলো আর আমার অবস্থানে আমাকে ফিরে যেতে নির্দেশ দেওয়া হলো। ঠিক সেই একই প্রহরী যে কিছুক্ষণ আগে আমাকে পাথর চুড়ে মেরেছিল আর বিরক্ত হয়ে আমাদের বলেছিল যে আমরা “শুকর”দের মধ্যে সহমর্মিতা মনোভাবের অভাব রয়েছে।
আরেক সময়, বনের ভেতর ২⁰ ফারেনহাইট তাপমাত্রার মাঝে পানির পাইপ বসানোর জন্য আমি বরফ জমে শক্ত হয়ে যাওয়া মাটির উপরের অংশ খুঁড়ছিলাম। ততক্ষণে আমি শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছি। সঙ্গে ছিল নিটোল গোলাপি গালের এক শ্রমিক প্রধান। তার অবয়ব আমাকে অবশ্যই শূকরের মাথার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল। আমি লক্ষ্য করি সেই তীব্র শীতের মধ্যে সে হাতে সুন্দর উষ্ণতার জন্য হাত-মোজা পরেছিল। কিছুক্ষণ নীরবে সে আমাকে লক্ষ্য করে দেখলো। আমার মনে হলো আমার জন্য কোনো বিপদ ঘনিয়ে আসছে কারণ আমি ঠিক কতটুকু মাটি কুড়ে ছিলাম তা আমার সামনের স্তূপটিতে প্রতীয়মান।
তারপর সে আরম্ভ করল: “ শুকর, পুরোটা সময় আমি তোমাকে লক্ষ্য করছিলাম”! এখনি আমি তোমাকে কাজ করা শেখাব! অপেক্ষা কর, এমন এক সময় আসবে যখন দাঁত দিয়ে তোমাকে ময়লা খনন করতে হবে – পশুর মতো তোমার মরণ হবে! দুই দিনের মধ্যেই আমি তোমাকে শেষ করে দেব! তোমার জীবনে তুমি কখনও ছোট কাজ করনি মনে হচ্ছে। তুমি আগে কি করতে, শুকর? কোনো ব্যবসায়ী?”
আমি তার কথাকে পরোয়া করতাম না। কিন্তু তার প্রাণ নাশের হুমকি আমাকে গুরুতরভাবে নিতে হয়েছিল। তাই সোজা হয়ে সরাসরি তার চোখে চোখে তাকিয়ে বললাম, “আমি ছিলাম একজন ডাক্তার-একজন বিশেষজ্ঞ।” কি? ডাক্তার? আমি নিশ্চিত তুমি মানুষের কাছ থেকে অনেক অর্থ হাতিয়েছ।” “তা ঠিক নয়, আমার অধিকাংশ কাজ আমি কোনো টাকা-পয়সা ছাড়াই, ক্লিনিকে গরীবদের জন্য করেছি।” কিন্তু ইতিমধ্যে আমার যথেষ্টই বলা হয়েছে। রাগে সে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে পাগলের মতো চিৎকার করতে থাকলো। সে কি চিৎকার করছিলো তা আমি আর মনে করতে পারছিনা।
Comments are closed.