man's search for meaning Bangla translation

Man’s Search for Meaning Bangla-ম্যান্স সার্চ ফর মিনিং জীবন বদলে দেওয়া Inspiring বইয়ের বাংলা অনুবাদ 2023

Last updated on January 24th, 2024 at 02:19 pm

মধ্যাহ্নভোজনের আধা ঘণ্টা বিরতির সময় আমাদের কাজের স্থানে হাতা দিয়ে তরল স্যুপ বিতরণ করা সময় আমাদেরকে একটি অসমাপ্ত ইঞ্জিন-কক্ষে জমায়েত হওয়ার অনুমতি দেওয়া হতো। ঢুকার সময়ে সবাই বাটিতে এক হাতা-পূর্ণ তরল স্যুপ নিয়ে আসতো। লোভনীয় ভঙ্গিতে আমরা যখন স্যুপে চুমুক দিতাম, তখন কোনো একজন বন্দী টবের উপর উঠে ইতালীয় অপেরা সঙ্গীত গাইত। আমরা তার সঙ্গীত উপভোগ করতাম। আর তার জন্য নিশ্চিত করা হতো দ্বিগুণ পরিমাণের স্যুপ, তাও আবার সোজা তলা থেকে—তার মানে সাথে মটরও।

কেবল বিনোদনের জন্যই শিবিরে কাউকে পুরস্কার দেওয়া হতো তা নয়, বরং হাততালি বা সাধুবাদের জন্যও কখনও কনও পুরস্কার মিলত। উদাহরণ সরূপ আমি শিবিরের অনেক কারণে “খুনি ক্যাপো” হিসেবে পরিচিত সবচেয়ে ভয়ানক ক্যাপুর কাছ থেকে সুরক্ষা পেতাম। ভালো যে তার সুরক্ষা আমার কখনো দরকার হয়নি! আর এভাবেই তার সাথে আমার পরিচয় ঘটে: এক সন্ধ্যায় পুনরায় যে কক্ষে মৃত ব্যক্তির আত্মার সাথে যোগাযোগের প্রার্থনা অনুষ্ঠান হয়েছিল সেখানে নিমন্ত্রণ পেয়ে মহা সম্মানিত হয়েছিলাম। সেখানে ছিল সেই প্রধান চিকিৎসকের কাছের বন্ধুরা। আর আবারও বেআইনিভাবে সেখানে উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য-সুরক্ষা দলের ওয়ারান্ট অফিসারটি। ঘটনাক্রমে খুনি ক্যাপোটি রুমে ঢুকলেই কেউ একজন তাকে তার একটি কবিতা আবৃত্তি করতে আহ্বান করেন। তার সে কবিতাটি এক সময় শিবিরে বিখ্যাত (বা কুখ্যাত) হয়ে উঠেছিল। তাকে আর দ্বিতীয়বার অনুরোধ করতে হয়নি এবং শীঘ্রই সে ডায়রির মতো কিছু একটা বের করে তা থেকে তার শিল্পের নমুনা সমূহ পড়তে আরম্ভ করেন। আমি তার একটি প্রেমের কবিতা শুনার পর হাসি আটকে রাখার জন্য আমি ঠোঁট কামড়ে ধরে রেখেছিলাম। এই হাসি চেপে ধরে রাখাটা সম্ভবত আমার জীবন বাঁচিয়েছিল। আমি যেহেতু করতালির বিষয়েও ছিলাম উদার। তাই এর আগে আমাকে এক দিনের জন্য তার কাজের দলে আমাকে নিযুক্ত করা হলে সা তার সাথে আমি তর্কাতর্কি করলেও কবিতা পাঠের সময় তার জন্যে প্রচুর হাততালি দেওয়াটা আমাকে বাঁচিয়েছিল। যাইহোক, সহায়ক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে খুনি ক্যাপোর সাথে পরিচিত হওয়াটা ছিল দরকারি বিষয়। তাই যতোটা সম্ভব শক্তভাবে আমি তার জন্যে হাততালি দিলাম।

নিঃসন্দেহে, সাধারণভাবে বলতে গেলে শিবিরের মধ্যে যে কোনো শিল্পের চর্চা ছিল কিছুটা হাস্যকর। আমি বলব যে, শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত যে কোনো কিছু থেকে তৈরি করা প্রকৃত ধারণা শুধুমাত্র নিঃসঙ্গ শিবির জীবনের আচরণ ও পরিবেশের মাঝে ভৌতিক বৈপরীত্য থেকে আবির্ভূত। অশউইৎয শিবিরে আমার দ্বিতীয় রাতে গানের আওয়াজে কিভাবে আমাকে আমার ক্লান্তির ঘুম থেকে জেগে উঠতে হয়েছিল তা কখনও ভুলতে পারবো না। ছাউনির সিনিয়র ওয়ার্ডেন বা প্ররক্ষক সে সময় তার কক্ষে কোনো একটা কিছু উৎযাপন করছিলেন। তার কক্ষটি ছিল ছিল ছাউনির প্রবেশ দ্বারের পাশে। আধ মাতাল শব্দে কিছু অতি প্রচলিত গানের সুর বেজে চলছিল। হঠাৎ তা নীরব যায়। তারপর রাতের গভীরতায় ভায়োলিনে এক নিদারুণ হতাশার সুর বাজতে শুরু করে। এ যেন এক স্বাভাবিক বাজনার দ্বারা নষ্ট না হওয়া অস্বাভাবিক সুর। ভায়োলিনটি যেন কেঁদেই চলছে। আর তার সাথে কেঁদে চলছিল আমার একটি অংশও। কারণ সে একই দিনটি ছিল কেউ একজনের চব্বিশতম জন্মদিন। আর সে ‘কেউ একজন’ ব্যক্তিটি অশউইৎয শিবিরের অন্য কোনো অংশে শুয়ে রয়েছে, সম্ভবত কেবল কয়েক শত বা কয়েক হাজার গজ দুরে কোথাও। তবুও যেন নাগালের বাইরে। আর সে ‘কেউ একজন’ ব্যক্তিটি ছিল আমার প্রিয়তমা স্ত্রী।

বন্দী শিবিরেও যে শিল্পের কোনও নমুনা ছিল তা আবিষ্কার করারটা একজন বহিরাগত ব্যক্তির পক্ষে যথেষ্ট অবাক করার বিষয় হতে পারে। কিন্তু সে এটা শুনে আরও বিস্মিত হতে পারে যে, একজন মানুষ সেখানে রসিকতা-বোধেরও সন্ধান পেতে পারে। তা অবশ্য রসিকতা-বোধের এক দুর্বল উপস্থিতি বা, হতে পারে কেবল কয়েক সেকেন্ড বা কয়েক মিনিটের জন্য। আত্ম-রক্ষা বা আত্ম-সংরক্ষণ সংগ্রামে রসিকতা ছিল আত্মা বা সত্ত্বার আরেকটি হাতিয়ার। এটি সবারই জানা আছে যে, যে কোনও কিছুর চেয়ে রসিকতা মানব চরিত্রে উদাসীনতা নিয়ে আসে। এবং রসিকতা মানুষকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য হলেও যেকোনো পরিস্থিতির উর্ব্ধে উঠার সামর্থ্য দান করে। নির্মাণ স্থানে আমার পাশাপাশি কাজ করা আমার এক বন্ধুকে আমি কার্যকরীভাবে রসিকতা-বোধ বৃদ্ধি প্রশিক্ষণ দিয়েছিলাম। আমি তার কাছে একদিন আমাদের মুক্তির পরে ঘটতে পারে এমন কিছু ঘটনাকে কেন্দ্র করে চিত্তাকর্ষক কিছু গল্প উদ্ভাবন করতে একে অপরের কাছে প্রতিজ্ঞা করার প্রস্তাব করেছিলাম। তিনি ছিলেন একজন সার্জন ও বিশাল এক হাসপাতালের স্টাফদের সহযোগী হিসেবে কাজ করছিলেন। তাই শিবির থেকে বের ছাড়া পাওয়ার পর আগের পেশায় ফিরে গেলে শিবির জীবনের অভ্যাস বদলানো কতোটা অসম্ভব হতে পারে তা বর্ণনা করে আমি তাকে হাসাতে চেষ্টা করেছিলাম। কর্মকর্তারা কাজের তদন্ত করতে আসার সময় নির্মাণ স্থানে আমাদের কাজের মাঝি বা দলনেতা আমাদের Action! Action! চিৎকার করে দ্রুত কাজ করার তাড়না দিতো। তা নিয়ে একদিন আমি আমার বন্ধুকে বলেছিলাম, একদিন তুমি হাসপাতালের অস্ত্রোপচার কক্ষে ফিরে গিয়ে বড় কোনো পেটের অপারেশন করবে। আর হঠাৎ এক বৃদ্ধ লোক দৌড়ে কক্ষে ডুকে গিয়ে Action! Action! চিৎকার করে সিনিয়র সার্জনের আগমনের বিষয়ে সতর্ক করে দেবে।

মাঝে মাঝে অন্যান্য লোকেরাও তাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে চিত্তাকর্ষক স্বপ্নের উদ্ভাবন করতো। এই যেমন ধরুন, তারা ভবিষ্যদ্বাণী করে বলতো যে, ভবিষ্যতে রাতের খাবার খাওয়ার ব্যস্ততায় স্যুপ বণ্টনের সময় তারা হয়তো তাদের নিজেদের পরিবেশ ভুলে যাবে। আর দাওয়াত করা গৃহকত্রীর কাছে একহাতা স্যুপের জন্য অনুনয় করে বলবে “একটু তলা থেকে দেন”।

রসিকা-বোধ বৃদ্ধির প্রচেষ্টা ও পরিস্থিতিকে রসিকতার আলোকে দেখা হলো জীবন-যাপনের শৈল্পিকতা (the art of living) উন্নয়নের সময় অর্জিত এক কৌশল। তথাপি, বন্দী শিবিরে বাস করেও জীবন-যাপনের শিল্প অনুশীলন সম্ভব ছিল, যদিও যন্ত্রণা আর কষ্টভোগ ছিল সর্বত্র বিরাজমান। একটি উদাহরণের মাধ্যমে তা বর্ণনা করা যায়: একজন মানুষের যন্ত্রণা গ্যাসীয় বৈশিষ্ট্যের মতো। যদি নির্দিষ্ট পরিমাণের গ্যাস কোনো খালি চেম্বারে চালিত করা হয়, তাহলে তা সম্পূর্ণরূপে ও সমান্তরালভাবে চেম্বারটিকে পূর্ণ করে ফেলবে, চেম্বারটি আকারে কতো বড়ো তা কোনো বিষয় না। একইভাবে, যন্ত্রণা মানব-আত্মা এবং সচেতন মনকে সম্পূর্ণরূপে পূর্ণ করে ফেলে, আর সে যন্ত্রণা কতো বড় বা কতো ছোট তা কোনো বিষয় নয়। অতএব, মানব যন্ত্রণার ‘আকার’ সম্পূর্ণরূপে আপেক্ষিক।

এটাও সত্যি যে, খুব তুচ্ছ কোনো জিনিস আমাদের জীবনে মহা আনন্দের কারণ হতে পারে। অশউইৎয থেকে ডাক্সাওর সাথে সংযুক্ত আরেক শিবিরে আমাদের যাত্রার সময় যা হয়েছিল তার কথা বলা যাক, উদাহরণ সরূপ। আমাদের সবার ভয় করছিল যে আমাদের নিয়ে পরিবহনটি হয়তো মউথওসেন শিবিরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ডানিউব নদীর সেতুর কাছাকাছি আসতেই আমরা আরও উত্তেজিত হয়ে পড়িলাম। অভিজ্ঞ সফর সঙ্গীদের বর্ণনানুযায়ী মউথওসেন পৌছার জন্য পরিবহনটি সেতুটি পার হয়ে যাওয়ার কথা। যারা এমন কিছু আগে দেখেনি তারা কয়েদিদের বহন করে নিয়ে যাওয়া পরিবহনের ভেতরে প্রদর্শিত এমন আনন্দের নাচ সম্ভবত কল্পনাও করতে পারবেনা। যখন তারা দেখল যে পরিবহনটি সেতুর উপর দিয়ে না গিয়ে বরং সোজা ডাক্সাওর অভিমুখে এগিয়ে চলছে তখন তারা আনন্দোল্লাস করতে থাকে।

দুইদিন তিন রাতের যাত্রা শেষে যখন আমরা ডাক্সাও শিবিরে পৌঁছানোর পর কি ঘটেছিল? পরিবহনের ভেতরে এক সাথে মেঝেতে গুটিসুটি করে বসার জন্য সবার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা ছিল না। আমাদের অনেককেই পুরো পথ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল। আবার কয়েকজন পালা করে মানুষের প্রস্রাবে সিক্ত সামান্য খড়ের উপর উবু হয়ে বসে আসতে হয়েছিল। শিবিরে পৌঁছানোর পরপরই সবচেয়ে যে গুরুত্বপূর্ণ বার্তাটি পুরনো কয়েদিরা আমাদের দিয়েছিল তা হলো আয়তনে ছোট (২৫,০০ জনসংখ্যা) শিবিরটিতে কোনো ‘চুল্লি’, শব-চুল্লি কিম্বা গ্যাসও নাই! তার মানে ‘মুসলেম’ হিসেবে আখ্যা পাওয়া কোনো ব্যক্তিকে সোজাসুজি গ্যাস-চেম্বারে নিয়ে যাওয়া হবে না, কিন্তু তাকে তথাকথিত ‘অসুস্থ কনভয়’ এর আয়োজন করে অশউইৎয শিবিরে ফেরত পাঠানো পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এই আনন্দদায়ক চমক আমাদের সবার মেজাজ ভালো করে দিয়েছিল। অশউইৎয শিবিরের সিনিয়র ওয়ার্ডেনদের প্রত্যাশা সত্যি হলো: যত দ্রুত সম্ভব আমরা অশউইৎয শিবির থেকে আলাদা এমন এক শিবিরে এসে পড়লাম যেখানে কোনো ‘চিমনী’ই নাই। আমরা হাসলাম এবং পরবর্তী মুহূর্তে আমাদেরকে যার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল তা সত্ত্বেও আমরা রসিকতা করছিলাম।

**********

আমাদের নতুন আগতদের গণনা করে বোঝা গেলো যে আমাদের একজনকে পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই শিবিরের বাইরে বৃষ্টি আর ঠাণ্ডা বাতাসে হারিয়ে যাওয়া সে ব্যক্তিকে ফিরিয়ে না পাওয়া পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল। অবশেষে তাকে এক ছাউনিতে আবিষ্কার করা হলো, যেখানে সে ক্লান্ত হয়ে সেখানে ঘুমিয়ে পড়েছিল। তারপর নাম ডাকা পর্ব হয়ে উঠে এক শাস্তি দেওয়ার দৃশ্য। সারা রাত পার করে পরের দিনের পড়ন্ত সকাল পর্যন্ত দীর্ঘ যাত্রার পর হিমায়িত আর সিক্ত অবস্থায় আমাদেরকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হলো। আর তারপরও আমরা ছিলাম খুবই আনন্দিত! এই শিবিরে কোনো চিমনী নাই আর অশউইৎয ছিল অনেক দুরে।

আরেক সময় আমরা দেখি একদল আসামী আমাদের কাজের স্থান পার হয়ে চলে যাচ্ছে। কতো স্পষ্টভাবেই না সমস্ত যন্ত্রণার আপেক্ষিকতা তখন আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছিল! সেসব বন্দীদের সু-শৃঙ্খল, নিরাপদ আর সুখী জীবন দেখে আমরা হিংসে করেছিলাম। নিশ্চয় তাদের প্রতিদিন স্নান করার সুযোগ আছে, বিষণ্ণ-ভাবে আমরা ভাবতাম। নিশ্চয় তাদের জন্য রয়েছে দাঁত-মাজার ব্রাশ, কাপড় ধোয়ার ব্রাশ, প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা শোয়ার জন্য মেট্রেস। তারা হয়তো তাদের আত্মীয়-স্বজনদের খবরা-খবর নিয়ে প্রতি মাসে চিঠি-পত্র দেওয়া-নেওয়া করে। তারা অন্তত তাদের আত্মীয়-স্বজন বেঁচে আছে না মরে গেছে তার খবর জানে। যার সব আমরা অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছিলাম।

আহা, আমাদের কেউ যখন কোনো কারখানায় প্রবেশের সুযোগ পেত এবং ছায়া ঘেরা কক্ষে কাজ করতো তখন আমরা তাকে কতইনা ঈর্ষা করেছি! এরকম জীবন-রক্ষামুলক সৌভাগ্য পাওয়ার প্রত্যাশা ছিল সবার। তুলনামূলক সৌভাগ্যের স্তর আরও বহুদূর বিস্তার লাভ করেছিল। এমন কি শিবিরের বাইরের সেই বিশেষ সৈন্য দলের মাঝেও (যার একটির আমিও একজন সদস্য ছিলাম) এমন কয়েকটি ইউনিট ছিল যাদের অন্যদের চেয়ে খারাপ বলে বিবেচনা করা হতো।  প্রতিদিন বারো ঘণ্টা ধরে ছোট কোনো মাঠের রেলপথের টব খালি করে গভীর কাদা মাটির খাড়া ঢালুতে হেটে যাওয়ার প্রয়োজন হতো না এমন ব্যক্তিকে যে কেউ হিংসে করতো। এ কাজে অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটতো, এবং এসব দুর্ঘটনা ছিল প্রায়শই প্রাণঘাতী।

অন্যান্য কাজের আসরে মাঝিরা শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে আপাতদৃষ্টিতে স্থানীয় ঐতিহ্য বজায় রেখেছিল, যা আমাদেরকে এরকম মাঝির আদেশের অধীনে না থাকার বা অল্প সময়ের জন্য থাকার তুলনামূলক সৌভাগ্যের ব্যাপারে আমাদের কথা বলতে হয়েছিল। একদা, দুর্ভাগ্যক্রমে আমি এমন এক আসরে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। দুই ঘণ্টা পর যদি জরুরী সতর্কীকরণ এলার্মটি আমাদের ব্যাঘাত ঘটিয়ে শ্রমিকদের পরবর্তীতে পুনঃ সংগঠিত করার প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি না করতো, তাহলে আমার মনে হয় যারা ইতিমধ্যে কাজ করতে করতে মারা গেছে বা ক্লান্ত হয়ে মৃত্যু পদযাত্রী হয়ে পড়েছে এমন লোকদের বহন করা কোনো এক স্লেজগাড়িতে করে আমাকে শিবিরে ফিরে যেতে হতো। এহেন পরিস্থিতিতে সাইরেনটি যে কতো বড় স্বস্তির কারণ হতে পারে তা কেউ কল্পনাও করতে পারবেনা। এমনকি কোনো রাউন্ড শেষ হওয়ার ঘণ্টা শুনে শেষ মুহূর্তে নকআউট হওয়ার বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া কোনো বক্সারও তা বুঝতে পারবে না।

সবচেয়ে ছোট কোনো দয়া পাওয়ার জন্যও আমরা কৃতজ্ঞ ছিলাম। ঘুমোতে যাওয়ার আগ মুহূর্তে উকুন-মুক্ত হওয়ার সময়টির জন্যও আমরা আনন্দিত ছিলাম। যদিও কাজ হিসেবে তা কোনো আনন্দদায়ক কাজ ছিল না। কারণ তার জন্য আমাদেরকে উলঙ্গ হয়ে উত্তাপ-হীন ছাউনিতে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। তার উপর যেখানে ছিল সিলিং থেকে ঝুলতে থাকা পানির ফোঁটা থেকে তৈরি ধারালো বরফকণা। তবুও আমরা কৃতজ্ঞ ছিলাম, কারণ এসময়ে জরুরী সতর্কীকরণ এলার্মটি বেজে উঠত না আর বাতিও নিবিয়ে দেওয়া হতো না। কাজটি ঠিকমতো করতে না পারলে আমাদের অর্ধেক রাত পর্যন্ত জাগিয়ে রাখা হতো।

*******

শিবির জীবনের ছোট-খাট আনন্দগুলি “যন্ত্রণা থেকে মুক্তি” পাওয়ার জন্য এক ধরনের নেতিবাচক সুখের (negative happiness) সরবরাহ করেছিল। জার্মান দার্শনিক শওপেনহাউওয়ার বলেছিলেন যে নেতিবাচক সুখ আমাদের “যন্ত্রণা থেকে মুক্তি” থেকে মুক্তি দেয় —তাও আবার কেবল কোনো আপেক্ষিক উপায়ে। প্রকৃত ইতিবাচক আনন্দ (positive pleasures), হোক তা ক্ষুদ্রতম, ছিল খুবই কম। আমার মনে পড়ে একদিন আমি আমার আনন্দের হিসেব কষছিলাম। তাতে আমি বুঝতে পারি যে বিগত বেশ কয়েক সপ্তাহে আমার শুধু দুইটি আনন্দময় মুহূর্ত ছিল। একটি ছিল কাজ থেকে ফেরার সময় দীর্ঘ অপেক্ষার পর আমাকে যখন রান্নাঘরে প্রবেশের অনুমতি দেত্তয়া হয়েছিল। আমাকে কারা পাচক মিঃ এফ’র সামনে দাঁড়ানো সারিতে নিযুক্ত করা হয়েছিল। তিনি বিশাল এক কড়াইয়ের পেঁছনে দাঁড়িয়ে তাড়াতাড়ি করে লাইনে দাঁড়িয়ে যাওয়া কয়েদিদের তুলে ধরা বাটিতে হাতা দিয়ে স্যুপ তুলে দিচ্ছিলেন। তিনিই ছিলেন একমাত্র রাঁধুনি যে বাটিতে স্যুপ দেওয়ার সময় বাটি ধরে থাকা লোকদের দিকে তাকাতেন না। তিনিই ছিলেন একমাত্র রাঁধুনি যে গ্রহীতা নির্বিশেষে সবাইকে সমানভাবে স্যুপ বরাদ্দ করতেন। আর যিনি নিজের বন্ধু বা নিজের দেশের লোকদের খাতির করতে গিয়ে বেছে বেছে আলু দিয়ে অন্যদের বাটিতে সেঁকে সেকে কেবল পাতলা স্যুপ দেওয়ার মানুষ তিনি ছিলেন না।

যারা তাদের নিজের লোকদের অন্যদের উপরে স্থান দেয় এমন বন্দীদের বিচার করা আমার কাজ নয়। আগে-পরে বাঁচা-মরার প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় এমন পরিস্থিতিতে তার বন্ধুদের প্রতি দয়া দেখানো এমন এক মানুষের প্রতি কে পাথর ছুড়তে পারে? কারো তা বিচার করা উচিৎ নয়, যদি না সে পরম সততার সাথে এমন পরিস্থিতিতে সে নিজেও একই কাজটি করতেন কিনা তার উত্তর দিতে পারে।

*****

শিবির থেকে মুক্তি পাওয়ার পর আমার স্বাভাবিক জীবন শুরু করার অনেক দীর্ঘ সময় পর কেউ একজন আমাকে এক সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনে শিবিরের বাঙ্কারে জনাকীর্ণ অবস্থায় শুয়ে এক পরিদর্শকের দিকে নিষ্প্রাণ ভঙ্গিতে কয়েদিদের তাকিয়ে থাকার ছবি দেখায়। “ভয়ানক না?, ভয়ঙ্কর বিস্ফোরিত চেহারা সব—এর সবকিছুই ভয়ানক”, লোকটি মন্তব্য করেন।

“কেনো”? আমি জিজ্ঞেস করলাম, কারণ আমি আসলেই তার কথা বুঝতে পারিনি। সেই মুহূর্তে ছবিটি আমি পুনরায় দেখলাম: ভোর ৫ টায় বাইরে তখনও ঘোর অন্ধকার। আমি তখন মাটির তৈরি এক ছাউনির তক্তায় শুয়েছিলাম যেখানে আমাদের সত্তর-জনকে ‘দেখাশুনা করা’ হচ্ছিল। আমরা অসুস্থ ছিলাম বলে আমাদের কাজের উদ্দেশ্যে ক্যাম্প ছাড়তে হয়নি, যেতে হয়নি প্যারেডেও। অসুস্থ ছিলাম বলে ছাউনির ছোট কোণে আমরা সারাদিন শুয়ে থাকতে, ঝিমোতে ও প্রতিদিনের বরাদ্দ রুটির এবং দৈনিক সুপ সহায়তা পাওয়ার অপেক্ষা করতে পারতাম। রোগীদের জন্য এই রুটি ক্রমে ছোট হয়ে আসে আর আমাদের বেলায়  স্যুপ হয়ে উঠে আরও পাতলা হয়ে ও পরিমাণে কম। সবকিছু পরও আমরা কতই সন্তুষ্ট আর না খুশি ছিলাম! এক সময় আমরা অলসতা আর আগ্রহহীনতার দরুন একটি আঙ্গুলও নাড়তে রাজি না হয়ে অপ্রয়োজনীয়ভাবে উঞ্চতা হারানো রোধ করতে আমরা যখন একে অন্যের কাছাকাছি ঘেঁসে গুটিসুটি হয়ে বসে থেকেছিলাম। তখন আমরা হঠাৎ উন্মুক্ত স্থান থেকে ভেসে আসা কর্কশ বাঁশির শব্দ এবং মানুষের চিৎকার শুনতে পেয়েছিলাম। সেখানে রাত্রিকালীন পালা ফিরে এসেছে আর নাম ডাকার জন্য সমবেত হচ্ছিল। ঠিক তখনই দরজাটা সজোরে খুলে গিয়ে তুষার-ঝড় বয়ে যায় আমাদের ছাউনিতে। একজন ক্লান্ত সহকর্মী বরফে ঢেকে যাওয়ার কারণে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে ভিতরে কয়েক মিনিটের জন্য বসে পড়েছিলেন। কিন্তু সিনিয়র ওয়ার্ডেন তাকে পুনরায় বাইরে নিয়ে যান। লোকজনের উপর পরীক্ষা চলাকালীন ছাউনিতে অপরিচিত কাউকে ঢুকতে দেওয়া ছিল সম্পূর্ণ নিষেধ। আমার সহকর্মীটির জন্য কতই না দুঃখ পেয়েছিলাম। আর সেই মুহূর্তে তার মতো একই পরিস্থিতির শিকার না হয়ে বরং অসুস্থ থেকে রোগীদের কোয়ার্টারে ঝিমাতো পারার কারণে কতই না আনন্দিত ছিলাম! রোগীদের কোয়ার্টারে দুটি দিন কাজ ছাড়া থাকতে পারাটা কতটাই না জীবন-রক্ষাকারী ছিল!

ম্যাগাজিনের ছবিগুলি দেখার পর এসব আমার মানসপটে ফিরে আসে। ব্যাখ্যা করার পর আমার শ্রোতারা বুঝতে পারে কেন ছবিগুলি আমার কাছে ততটা ভয়ানক ছিল না: যাইহোক, ছবিতে দেখানো মানুষগুলি হয়তো তেমনটা অসুখী ছিল না।

রোগীদের কোয়ার্টারে আমার চতুর্থ দিনের দিন প্রধান চিকিৎসক এসে আমাকে রাত্রিকালীন পালা সম্পর্কে বিস্তারিত বললেন আর টাইফাস রোগী সংবলিত অন্য একটি শিবিরে আমাকে মেডিকেল দায়িত্ব পালনের অনুরোধ করা হলো। আমার বন্ধুদের জরুরী উপদেশ আর এবং আমার প্রায় সব সহকর্মী তাদের সেবা দানের পক্ষে নারাজ থাকা সত্ত্বেও আমি স্বেচ্ছা সেবা দিতে সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি জানতাম যে কোনো কাজের আসরে আমি অল্প সময়ের মধ্যে মারা যাবো। আমার যদি তাদের সেবায় মৃত্যুও হয় তবুও তা অর্থবহ হবে। আমি ভাবলাম যে নিষ্ক্রিয় হতে হতে অবশেষে অনুৎপাদনশীল শ্রমিক হিসেবে মরে যাওয়ার চেয়ে একজন চিকিৎসক হিসেবে আমার সহকর্মীদের সহায়তা করা হবে নিঃসন্দেহে অর্থবহ।

আমার জন্য তা ছিল এক সাধারণ অঙ্ক, কোনো ত্যাগ বা বিসর্জন নয়। কিন্তু গোপনে, স্বাস্থ্যসুরক্ষা দলের ওয়ারান্ট অফিসারটি আদেশ করলেন যে, যে দুজন চিকিৎসক টাইফাস শিবিরে স্বেচ্ছা সেবা প্রদান করবে তাদের অবশ্যই তাদের রওয়ানা হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত “সেবা প্রদান” করা হবে। আমাদের দেখতে এতই দুর্বল মনে হচ্ছিল যে তিনি তার হাতের কাছে দু’জন ডাক্তারের পরিবর্তে আরও দু’টি অতিরিক্ত লাশ রয়েছে চিন্তা করে ভয় পেয়েছিলেন।

আমি আগেই উল্লেখ করেছি কিভাবে কারো নিজের বা কাছের বন্ধুর জীবন রক্ষা কাজে সরাসরি সম্পৃক্ত নয় এমন যেকোনো কিছুই মূল্যহীন হয়ে পড়েছিল। বাঁচিয়ে থাকার বা বাঁচিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে সবকিছুই বিসর্জন দেওয়া হয়েছিল। এই জায়গায় একজন মানুষের চরিত্র এমনভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছিল যে, সে মানসিক অশান্তিতে ধরাশায়ী হয়ে পড়ে যা তার সমস্ত মূল্যবোধকে হুমকির মুখোমুখি করে সন্দেহের মধ্যে নিক্ষেপ করেছিল। যে জগত মানব জীবনের মূল্যের স্বীকৃতি দেয় না, যে জগত মানুষের ইচ্ছাকে ছিনিয়ে নিয়ে তার শরীরের শেষ সম্বলটুকু পর্যন্ত ব্যবহার হয়ে যাওয়ার পর তাকে ধ্বংশ করে ফেলার এক বস্তুতে পরিণত করেছিল, এমন জগতের প্রভাবে অবশেষে সে তার ব্যক্তিগত অহং মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলে। বন্দী শিবিরের লোকটি যদি তার আত্ম-সম্মান রক্ষার্থে এর বিরুদ্ধে শেষ পর্য্ন্ত সংগ্রাম করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে আভ্যন্তরীণ স্বাধীনতা আর ব্যক্তিগত মূল্যবোধ সম্বলিত এক মননশীল সত্ত্বা হিসেবে তার অনুভূতি হারিয়ে ফেলতো। সে তখন নিজেকে বিশাল জনগোষ্টির নিছক একটি অংশ হিসেবে ভাবতে শুরু করে দিতো। আর তার অস্তিত্ব এক পশুর জীবনের পর্যায়ে নেমে আসতো। তারপর চিন্তা-চেতনা বা স্ব-ইচ্ছাহীন ভেড়ার পালের ন্যায় মাঝে মাঝে এক সাথে তারপর পৃথকভাবে তাদের তাড়া করে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়া হতো। ছোট কিন্তু বিপজ্জনক নির্যাতন পদ্ধতি ও ধর্ষকামে অভিজ্ঞ একঝাক শিকারী কুকুর তাদের চারপাশ থেকে লক্ষ্য ঘিরে থাকতো। তারা বিরতীহীনভাবে ভেড়ার পালটিকে চিৎকার করে, লাথি মেরে এবং বেত্রাঘাত করে কখনও সামনের দিকে, কখনও পিছনের দিকে চালিত করতে থাকে। আর ভেড়া হিসেবে আমরা শুধু দুটি ভাবনায় আবিষ্ট থাকতাম—কিভাবে মন্দ কুকুরকে এড়িয়ে চলবো এবং কিভাবে একটু খাবার পাবো।

Comments are closed.

Scroll to Top